জীবনের ঘোর, জীবনের গল্প // দিব্যেন্দু দ্বীপ

follow-upnews
0 0

ইতিহাস বলি। প্রেমে পড়ার ইতিহাস। বাঁচার ইতিহাস, বাঁচানোর ইতিহাস। হেরে যাওয়ার ইতিহাস, বিজয়েরও। আমার ক্ষেত্রে ইতিহাসটা শুরু হয়েছিল ক্লাস এইট থেকে। প্রেমে পড়লাম, এই পড়াপড়িটা এবং মনে মনে গড়াগড়ি চলল এসএসসি পরীক্ষার আগ পর্যন্ত।

এসএসসি পরীক্ষার পর প্রস্তাব করলাম অন্য একজনকে। তাও আবার কৌশলে। একজন ফার-ব্লাড কাজিনকে প্রস্তাব করেছিলাম। বলেছিলাম, তোমাকে-আমাকে নিয়ে অন্যরা এইসব এইসব বলছে। আশা করেছিলাম—

ও বলবে, ঠিকই তো বলছে, আমরা তো তাই-ই আসলে। কিন্তু ও আমাকে সাহারা মরুভূমিতে ছিটকে দিয়ে বলল, তুমি তাদের বলো নাই আমি যে তোমার বোন হই? আমি মিনমিনে করে বললাম, বলেছি তো!

এরপর ঘটনা ইন্টার ফাস্ট ইয়ারে থাকতে। বাগেরাট পিসি কলেজে ভর্তি হলাম। সেখানে শহরের ভালো সুন্দর সুন্দর অনেক মেয়ে, ভালো ছাত্রীও তারা। আমি অসহায় বোধ করতে থাকলাম।

অল্পদিনেই বুঝে গেলাম, কঠিন কঠিন সায়েন্সের পড়াশুনা কিছুই বুঝতে পারছি না। সবাই ক্লাস করছে, প্রাইভেট পড়ছে, কিন্তু আমার কিছু করণীয় নেই, প্রাইভেট পড়ার টাকা নেই। বিনা পয়শায় একটা ব্যাচে ম্যাথ পড়া ঠিক হয়েছিল। কিন্তু বিনা পয়শায় পড়া আমাকে মানালো না। দেখলাম, খুব ছোট হয়ে যাই সবার মধ্যে যখন শিক্ষক মাস শেষে হিসেব করেন আমাকে বাদ দিয়ে। সাত আট দিন পড়ে বাদ দিলাম পড়া।

কী আর করব, পড়াশুনা যেহেতু নাই, আবার প্রেমে পড়ায় মনোযোগী হলাম। পাশের গার্লস কলেজের এক মেয়েকে আমার ডেরায় নিমন্ত্রণ জানালাম। রামকৃষ্ণ মিশনে থাকতাম। মিশনের নিয়ম ছিলো কোনো মেয়ে বন্ধু আনা যাবে না। নিয়ম ভুলে মেয়ে বন্ধু একেবারে রুম পর্যন্ত আনলাম। বন্ধুবান্ধব সবাই নিয়মের ব্যত্যয় এবং ষোড়শী দেখতে হাজির হয়েছিল। অনেকে তখন সার্কাস দেখে গিয়ে নালিশ জানিয়েছিল মহারাজের কাছে।

পরের দিনই শোকজ। এমনিতে সারা বছরের রুম ভাড়া বাকী। ক্যান্টিনে খাবারের বিল বাকী। তার ওপর নিয়মের ব্যত্যয়। কড়া ভাষায় সাবধান করা হলো আমাকে। এগারোতম মাসে গিয়ে আর পেরে উঠলাম না। মাসে শূন্য টাকার সংস্থান। এই অবস্থায় পড়াশুনা করার কোনো মানে হয় না। বুঝে গেলাম, উক্ত রুপসীও সাময়িক ঘোরে পড়েছিল মাত্র। আমি ভাই জায়গার গুটি জায়গায় গড়াই। ফিরে আসলাম মামাবাড়ী।

ফিরে দেখলাম, যে সম্রাজ্য একবার ছেড়ে গিয়েছি তা আর ফিরে পাবার উপায় নেই। তুচ্ছ তাচ্ছিল চারিদিক থেকে। বাড়ী বসে কিছুদিন পড়াশুনার চেষ্টা করে অবশেষে পরীক্ষায় বসলাম, তিনটে পরীক্ষা দিয়ে বুঝলাম কোনোমতে পাশ করব হয়ত, তার চেয়ে পরীক্ষা বাদ। বাদ দিলাম। পরীক্ষা বাদ দিয়ে এলাকায় ফিরলে অবস্থা আরো খারাপ হলো।

মামাবাড়ী আর থাকতে ইচ্ছে করল না। অবশেষে একটা সুযোগ মিললো। বিভাষ দা (মাসতুত ভাই) খুলনায় একটা দোকান দিয়েছে, তার একজন সাহায্যকারী প্রয়োজন। তখন এটা আমার জন্য অনেক বড় সুযোগ ছিলো।

দেখবেন, এরকম মাঝে মাঝে হয়, কোনো একটা হিল্লে পেলেই “এ জায়গা ছাড়তে পারলে বাঁচি।” অনেক সময় সঙ্গীও এমন বিরক্তিকর হয়ে উঠতে পারে। তখনই বাইরের হাতছানি চন্দ্রালোক হয়ে আসে। মনে হয়, সে যখন ডাকছে অনেকদিন ধরে, যাই না হয়, যা আছে কপালে। আমরা ভাবি— স্বামী-স্ত্রী কেন পরস্পরকে ছেড়ে যায়, কিন্তেু যে যায় সে জানে জীবন কতটা দুর্বিসহ হতে পারে।

আমারও তখন সেই অবস্থা। যেতে পারলে বাঁচি।

খুলনায় বিভাষ দা’ র দোকানে বসা শুরু করলাম। দোকানে মোবাইল, টেলিফোন এবং কম্পিউটার। আমি বসে থাকি, কিন্তু কোনো কাস্টমার আসে না। মাঝে মাঝে একজন আমেরিকান ভদ্রমহিলা আসতেন। ধপধপে সাদা, আমার ‘ডাবল’ লম্বা, স্মার্ট।

আমি তক্কে তক্কে থাকতে শুরু করলাম, কবে তার প্রেমে পড়া যায়। কিন্তু বিভাষ দা’কে মাড়িয়ে সে সুযোগ ছিলো না। তারপরেও একদিন দু’টো বাক্য নিক্ষেপ করেছিলাম কথা বলা শুরু করতে চেয়ে। উনি মৃদু হাসি সহ সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে অবজ্ঞা করেছিলেন। বাক্য দুটি এমন কিছু নয়, তখন যতটুকু যা ইংরেজি পারি— “হাউ আর ইউ, আই ওয়াজ ওয়েটিং” টাইপের।

তিনচার মাস চলে গেল, বিভাষ দা বুঝে গেলেন, ব্যবসা তাকে দিয়ে হবে না। আমিও চোখে শর্ষে ফুল দেখতে শুরু করলাম যুগপৎ।

টিউশনির আশায় খোঁজ খবর শুরু করলাম। খুলনার কোনো এক কলেজের এক শিক্ষকের কাছে গুণে গুণে ছাব্বিশ দিন গিয়েছিলাম একটা টিউশনির জন্য, কিন্তু উনি আমায় শুধু বসিয়ে রেখেই যে মজা পেতেন সেটি এখন বুঝি।

অবশেষে খুলনা রয়েল হোটেলের পিছনে ক্লাস ফাইভের একটি মেয়েকে পড়ানো শুরু করলাম। টিউশনিটা কীভাবে পেয়েছিলাম মনে নেই। ওকে পড়িয়েছিলাম সম্ভবত তিন মাস। তারপর ইচ্ছে করেই ছেড়েছিলাম। সাথে আরো দু’টো টিউশনি শুরু করেছিলাম। সম্ভবত প্রসুন নামে ক্লাস এইটের একটি ছেলেকে কিছুদিন পড়িয়েছিলাম।

সবকিছু ভুলতে পারি, কিন্তু ক্লাস ফাইভের ঐ শিশুটিকে ভুলতে পারি না আজও, সম্ভবত এটাই সবচে’ পবিত্রভাবে প্রেমে পড়া আমার জীবনে। এতটা বুদ্ধিমতী ছাত্রী ছিলো ও!

এরপর তো নতুন ইতিহাস। হঠাৎ মনে হলো, আরে আমার তো ইন্টার পাসটাও তাহলে করা হচ্ছে না। তখনও টেস্ট পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ আছে কলেজে। টেস্ট পরীক্ষা দিলাম দুটো, শুধু বাংলা এবং ইংরেজি। এরপর প্রিন্সিপালকে অনুরোধ করে ফরম ফিলাপ করেছিলাম।

ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে ঢাকায় এসে আবার একই ইতিহাস শুরু হল নতুনভাবে। ক্লান্তিকর, ভীষণ ক্লান্তিকর অবস্থা। ভাবলাম, পড়াশুনায় আর কাজ নাই। টিউশনি শুরু করলাম, এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, অবশেষে আটটা টিউশনি। টিউশনি প্রথমদিকে পাওয়া খুব সহজ ছিল না। সেও আরেক বঞ্চনার ইতিহাস।

সবাই মেয়ে। অর্থাৎ আমি তখন আটজন এসএসসি এবং এইসএসসি’র ঢাকাইয়া মেয়ে পড়াই। তখন হাটু পর্যন্ত লম্বা জামা পরি, সম্বল একটা বাটার স্যান্ডেল, আর ঢোলা একটা প্যান্ট। কিন্তু তাতে কোনো সমস্যা ছিল না, সমস্যা হচ্ছিল পড়াতে। পড়ানোর জন্য বাসায় নিজের প্রচুর পড়তে হত।

আবার প্রেমে পড়তে ইচ্ছে হলো। কিন্তু নিজেকে নিজের কারো জন্য পছন্দ হলো না। টাকা আয় করি, পরিবারের দায়িত্ব নিয়ে ফেললাম পুরো দস্তুর। নিজের পোশাক পরিচ্ছদ পরিবর্তন করতে শুরু করলাম, সে এক হাস্যকর ইতিহাস— বডি স্প্রেও কিনলাম। ফুসফাস মারতাম গায়, বিশেষ করে টিউশনিতে যাওয়ার আগে।

অবেশেষে একদিন টনক নড়ল। আরে বাল আমি তো আসলে কিছুই না, সত্যি কথা বলতে লিটারেলি বডি স্প্রেটা জানলা দিয়ে টান মেরে ফেলে দিয়েছিলাম। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ ছিল।

ইতোমধ্যে প্রেমে পড়া হয়ে গেছে। এবার অবশ্য ব্যতিক্রম, আমাকে প্রেমে পড়ানো হয়েছে, অবশ্য আমারও দায় ছিল যথেষ্ট— সে অবশ্য হাবভাবে।

কিছু বইপত্র সংগ্রহ করে আরেকটা শর্টকার্ট ড্রাইভ দিলাম। কোনোমতে ঢাবিতে ভর্তি হলাম। প্রথমদিন ক্লাসে গিয়ে দেখলাম, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ সুন্দরীদের অভয়ারাণ্য। কয়েকদিন ক্লাস করে বুঝলাম, এই সিলেবাস মুখস্থ করার চেয়ে পারিবারিক বাস্তবতা যা তাতে পড়াশুনা বাদ দিয়ে হাতে থাকা প্রেমটা কনটিনিউ করি, আর পরিবারের ভরণপোষণ করি।

একটা কথা চুপেচাপে বলে রাখি, বিভাগেও আমি একটা প্রেমে পড়েছিলাম। জানি না সে বুঝতে পেরেছিল কিনা। তবে বাস্তবতা মেনে নিয়ে উপার্জনে মনোনিবেশ করলাম, পরিবারের সমস্ত দায় নিলাম খুব জোরেসোরে। ভাই-বোন সবকিছু।

কিন্তু স্বভাববশত জড়িয়ে গেলাম রাজনীতি আড্ডা ইত্যাদি অনেক কিছুর সাথে। শুধু বিভাগের কোনো কর্মকাণ্ডে আমি নেই। পড়াশুনাও কিছু করি না। ইনকোর্স পরীক্ষা বেশিরভাগ দিই না।

এটা আসলে ভুল ছিল, একটু মনোযোগী হওয়ার দরকার ছিল। ততটুকু সময় বের করা যেত— অন্তত প্রেমটা বাদ দিয়ে হলেও, আড্ডাটা তো কমানো যেতই। অবশ্য এখন ভাবি— অতীতের সবকিছু মিলেই তো বর্তমান আমি। সবই সম্বল, পাথেয়, অনেক তার সম্পদও।

প্রেমের খবর মেয়ের অভিভাবক জেনে যাওয়ায় প্রেমে ছেদ পড়েছিল, তবে আমি গতিপ্রাপ্ত হলাম অন্য অনেক কাজে। প্রথম বর্ষ কেটে গেল। একটা সুবিধা এবং একইসাথে অসুবিধার বিষয় ছিল— আমার কোনো অভিভাবক ছিল না, এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার খবরটি জানাব এমন কেউও তখন আমার সাথে সেভাবে কানেকটেড ছিল না, বরং আমি-ই ছিলাম অনেকের অভিভাবক।

কিন্তু শুধু পারিবারিক দায়িত্ব মেনে নিতে পারতাম না কিছুতে। খুবই অস্থির লাগত মাঝে মাঝে। অনেক সামার্থ জলাঞ্জলি দিতে হয়েছিল সত্যিকারার্থে। রাতভর আড্ডা দিতাম। দিনে ক্লাস বাদ দিয়ে ঘুম বা কোচিং-এ ক্লাস নেওয়া।

অবচেতনে অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। সত্যি বলতে কিছু একটা (কাউকে) খুঁজতেছিলাম। এবার এক আপুকে মেসেজ পাঠালাম, তার ডাগর ডাগর চোখের প্রশংসা করে। আরো আরো কিছু কাব্য-কবিতা সম্ভবত। উনি তখন অর্থনীতি বিভাগে সম্ভবত তৃতীয় বর্ষে পড়তেন। আশ্চর্যজনক হচ্ছে— চৌদ্দ বছর পরে এসে উনি আমার প্রেমে পড়তে চেয়েছিলেন!

শেষ পর্যন্ত আর নিজেকে প্রকাশ করলাম না। কাউকে পাশে পাওয়াও আর হলো না, হয়নি, হবেও না। আড্ডা-টিউশনি-অন্যসব নিয়ে তখন জীবন। বিভিষীকা-বিভ্রান্তিও ছিলো অনেক। পরিবারের অবস্থা খারাপ থেকে খারাপতর হতে থাকল। আমি দিশেহারা না হয়ে ‘ওল্ডম্যান এন্ড দ্যা সি’র ওল্ডম্যানের মতো হাল ধরে থাকলাম শুধু।

প্রেমের কথাই যদি বলতে হয়, তাহলে বলি— এই বুড়ো বয়সে এসে আমি সত্যিকারার্থে একজনের প্রেমে পড়েছি বলে মনে হয়।

Next Post

জীবন ও জীবিকা

বাংলাবাজারের ঐ পথ দিয়ে যেতে যেতে রোজ ওনাকে দেখি। ভাবলাম, আজকে ওনার সথে কথা বলি। ওনার নাম হাসেম শেখ। বাড়ি বিক্রমপুরে। ছিচল্লিশ বছর ধরে এই জায়গাটিতে তিনি কলা বিক্রী করেন! জানি না ওনার মত দেশে ঠিক কত মানুষ আছে যারা রাষ্ট্রকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন আমৃত্যু নিভৃতে কোনো প্রতিদান ছাড়া …
বিক্রমপুর