বিড়ালের ফাঁসি দিয়ে ফেসবুকে: লুৎফর রহমান রিটনের বিস্ময় এবং বেদনা প্রকাশ

ধর্মীয় শিক্ষার সুফল

ফেসবুকে নিষ্ঠুর যে ছবিটা ভাইরাল হয়েছে:

মধ্যপ্রাচ্য ধর্মীয় শিক্ষা

লুৎফর রহমান রিটনের ফেসবুক স্টাটাস:

মানুষ তুমি মানুষ হও…
খুব অমানবিক হিংস্র একটা প্রজন্ম বেড়ে উঠছে আমাদের সমাজে, আমরা খেয়াল করছি না। আমাদের অজান্তেই মায়া মমতা প্রেম আর ভালোবাসাহীন একটা প্রজন্ম চরম নিষ্ঠুরতাকে উপভোগ করতে করতে বিকশিত হচ্ছে, আমরা টের পাচ্ছি না। আজ দুপুর থেকেই ভয়ংকর একটা কষ্ট আমাকে আমাকে স্বাভাবিক হতে দিচ্ছে না। ফেসবুকে ভেসে ওঠা একটা ছবি দুঃস্বপ্নের মতো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আমাকে। গত ছেচল্লিশ বছর ধরে এই যে এতো লেখালেখি করছি ছোটদের জন্যে, তাতে লাভটা হলো কি? ছোটদের মনোজগতে মানুষ-ফুল-পাখি-প্রজাপতি-পাহাড়-নদী-বৃক্ষ-সাগর-বেড়াল-হরিণ-খরগোশ এক কথায় প্রকৃতি ও প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসাই যদি নির্মাণ করে দিতে না পারলাম তাহলে এই ঘোড়ার ডিমের পণ্ডশ্রম করার দরকারটা কি!

প্রতিবাদ

নিজেকে ব্যর্থ মনে হচ্ছে। অপরাধী মনে হচ্ছে।

‘অবশেষে কবুতর এর খুনির ফাঁসি কার্যকর’ ক্যাপশনে কয়েকটা ছবি আপলোড করা হয়েছে চট্টগ্রাম থেকে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে উল্লসিত পাঁচ-ছ’জন শিশুকিশোর (সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্ক অভিভাবকও আছেন) একটা বেড়াল ছানার গলায় দড়ি বেঁধে ছাদ থেকে কার্ণিশের দিকে ঝুলিয়ে রেখেছে। অসহায় বেড়াল ছানাটা ঝুলছে, মৃত অবস্থায়! ছবিটার দিকে তাকানো যায় না! অসহায় বেড়াল ছানাটার জন্যে সেই দুপুর থেকেই বুকজুড়ে কেবল হাহাকার আর চাপা কান্না আমাকে তাড়িয়ে ফিরছে। আমি স্বাভাবিক হতে পারছি না কিছুতেই।
ওই ছবিটা আমাকে একজন ব্যর্থ মানুষ হিশেবে উপহাস করছে। শুধু আমাকে নয়, আমার মতো সকল শিশুসাহিত্যিককেই উপহাস করছে।

সত্যিকারের মানুষ হিশেবে আমরা আমাদের শিশুদের গড়ে তুলছি না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা জিপিএ ফাইভ পাওয়া ছেলেমেয়ে তৈরি করছে। অভিভাবকেরা ফাঁস হওয়া প্রশ্ন কিনে এনে তুলে দিচ্ছে সন্তানের হাতে! আমাদের কর্পোরেট বেনিয়ারা টেলিভিশনের মাধ্যমে নাচে-গানে ভরপুর একগুচ্ছ ‘তারকা পুত্র-কন্যা’ প্রডিউস করছে। ভূমিদস্যুরা আমাদের শিশুদের খেলার মাঠগুলো দখল করে এপার্টমেন্টের বস্তি বানিয়ে ফেলছে! শপিং কমপ্লেক্স আর ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের জোয়ারে লাইব্রেরিগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে! পাড়ায় পাড়ায় গড়ে ওঠা শিশুসংগঠনগুলোও উধাও! কোমলমতি শিশুদের মানসিক উৎকর্ষ সাধনের সকল প্রক্রিয়াকে ক্রমান্বয়ে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। যাবতীয় মানবিকতার চর্চা থেকে সরিয়ে আমরা আমাদের শিশুদের নৃশংসতা এবং নিষ্ঠুরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছি। সবাইকে মেরে কেটে বেরিয়ে যাবার বা এগিয়ে যাবার শিক্ষা দিচ্ছি। ভালোবাসার শিক্ষা দিচ্ছি না।
আর তাই ওরা হয়ে উঠছে হিংস্র দানব। ভয়ংকর অমানুষ!

আমি নিশ্চিত চট্টগ্রামের ওই পরিবারের অভিভাবকেরা পাঠ্যবইয়ের বাইরে এই বাচ্চাগুলোর হাতে কোনদিন ফেইরি টেলস কিংবা রূপকথার গল্পের বই তুলে দেয়নি। কিংবা তুলে দেয়নি কোনো ছড়া-কবিতার বই। যে বইগুলো পড়লে একটা বেড়াল বাচ্চার জন্যেও ওদের সন্তানের বুকের মধ্যে ভালোবাসার গোলাপ ফুটতো।

মানুষের চরম নিষ্ঠুরতায় মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে আর্তনাদ করতে থাকা বেড়াল বাচ্চাটার জন্যে কয়েক ফোঁটা অশ্রু ছাড়া আমার যে আর কিছুই দেবার নেই!
হায় কতো অসহায় আমি…
অটোয়া ১৬ মার্চ ২০১৮