সিন্ডিকেটে জিম্মি খুলনার ডিমের বাজার, স্থানীয় খামারিরা হুমকির মুখে

ডিম

খুলনা শহরে প্রতিদিন ডিমের চাহিদা রয়েছে প্রায় পাঁচ লাখ। প্রায় দুই লাখ ডিম স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হলেও বাকিটা আসে ঢাকাসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলা থেকে। খুলনায় ডিমের এই জোগান পাঠায় কিছু নামি-দামি প্রতিষ্ঠান। কাজী ফার্মস্ বলছে, তারা খুলনায় ডিম ঢুকায় দুই লাখ। এ ডিম পঞ্চগড় থেকে আসে বলে তারা জানায়। এত দূর থেকে ডিম এনেও কীভাবে তারা স্থানীয় খামারিদের সাথে প্রতিযোগিতা করছে, এমনকি অন্যদের তুলনায় ডিলারদের কাছে কিছুটা কমেও ডিম ছাড়ছে তারা?!

অনুসন্ধানে জানা যায়, এ সকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রধানত ১১টি ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো, ডায়মন্ড সিক্স লিমিটেড, সিপি বাংলাদেশ লিমিটেড, সাগুনা পোল্ট্রি এন্ড হ্যাচারি, প্যারাগন গ্রুপ, কাজী ফার্মস লিমিটেড, নারিশ পোল্ট্রি, আকিজ গ্রুপ, আফিল এগ্রো, আমান ফিড, আল মদিনা ও আস্থা পোল্ট্রি এন্ড হ্যাচারি।

দেশে প্রতিদিন প্রায় চার কোটি ডিমের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ তথা দুই কোটি ডিমের যোগান দেয় এই ১১টি প্রতিষ্ঠান। ফলে ডিমের দাম ওঠা-নামা অনেকটা নির্ভর করে শীর্ষস্থানীয় এ প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ছোটখাটো ডিম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও স্বল্প পুঁজির খামারিরা।

এ প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভর করতে হয় সাধারণ পাইকারি ব্যবসায়ীদের। সরবরাহ কমিয়ে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে এ সব প্রতিষ্ঠান দফায় দফায় ডিমের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। ভোক্তা পর্যায়ে বিপুল চাহিদা থাকায় সমাধান দিতে পারছে না সরকারি দপ্তরগুলো।  

পাঁচ মাস আগেও প্রতি পিস পোল্ট্রির ডিমের খুচরা মূল্য ছিল ৮ থেকে ৯ টাকা। কয়েক মাসের ব্যবধানে সেই ডিম এখন বিক্রি হচ্ছে ১৩ থেকে ১৪ টাকা পর্যন্ত। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, পাইকারি ১১ টাকা ৫০ পয়সা ও খুচরা ১২ টাকা বিক্রি করার কথা থাকলেও বেশিরভাগ খুচরা দোকানে লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৪ টাকায়। ক্রেতারা বলছেন, অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণে স্বল্প আয়ের মানুষ বিপাকে পড়েছে। 

ডিমের দাম বৃদ্ধির পেছনে পাইকারি বিক্রেতাদের দায়ী করছেন খুচরা বিক্রেতারা। আর পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, যোগান কম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৃহৎ ডিম উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি খুলনাসহ অন্যান্য জেলার প্রান্তিক খামারিরা। তবে অনুসন্ধানের দেখা গেছে সরবরাহকারীর তুলনায় ডিলার পয়েন্টে দাম প্রায় দেড় টাকা বেশি, ডিলার পয়েন্ট থেকে স্থানীয় পাইকারড়দের কাছে যেতে যেতে দাম আরো এক টাকা বাড়ে। কাজ ফার্মস্ খুলনায় ডিম ছাড়ছে এই মুহূর্তে ৯.৬১ টাকায়, তবে সেটি ডিলারদের কাছে। ডিলারেরা এই ডিম স্থানীয় পাইকাড়দের কাছে বিক্রি করছে ১০.৮০ টাকা থেকে ১১ টাকায়। পাইকাড় বিক্রি করছে ১২ টাকায়। খুচরো বিক্রেতা আরো ২ টাকা বাড়িয়ে দিচ্ছে। ডিমের বাজারে কমপক্ষে একটি হাত বেশি রয়েছে, এবং প্রত্যেকটি পয়েন্ট কমপক্ষে ৫০% ব্যবসা বেশি করছে।

এ সমস্যা সমাধানে সরবরাহকারীরা পাইকারদের ডিম দিতে পারতো, তাহলে ডিলারদের প্রয়োজন হত না, ডিলারেরা সরসরি খুচরা বাজারে ডিম পৌঁছে দিতে পারতো, তাহলে স্থানীয় পাইকাড়দের প্রয়োজন হত না, আর যদি সরবরাহকারী বা উৎপাদনকারীরা সরাসরি খুচরা দোকানে ডিম পৌঁছে দিতে পারতো, তাহলে ডিলার এবং পাইকাড় প্রয়োজন হত না, সেক্ষেত্রে স্থানীয় উৎপাদনকারী এবং ভোক্তারা লাভবান হত। মূলত পুঁজির সংকট এবং সঠিক পরিকল্পনার অভাবে স্থানীয় খামারিরা এ কাজটি করতে পারে না। পাশাপাশি ডিলার এবং এইসব পাইকাড়দের বাধাও রয়েছে। খামারিরা সরাসরি খুচরো বাজারে ডিম দিতে চাইলে তারা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, এরা রাজনৈতিক মদদপুষ্ট এবং চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করছে।

কাজি ফার্মস্ সহ বেশিরভাগ বড় প্রতিষ্ঠান শুধু তাদের তালিকাভুক্ত ডিলারদের কাছে  ডিম বিক্রি করে। কিন্তু এটা উন্মুক্ত থাকলে ডিমের বাজারে অস্থিরতা কমতো। মূলত কার্যকরভাবে বাজারের দখল নিতেই তারা এটি করতে বাধ্য হয়, যাতে তারা স্থানীয় প্রভাবশালীদের বাধার মুখে না পড়ে।

ডিমের বাজারে রং এবং সাইজও একটি বিষয়। কাজী ফার্মস্ শুধু লাল ডিম উৎপাদন করে থাকে, এবং তাদের সাইজও এক প্রকার। সাদা ডিমের দাম তুলনামূলক একটু কম, যদিও লাল বা সাদা ডিমে তাৎপর্যগত কোনো পার্থক্য নেই। বাজারে ডিমের সাইজভেদে যে দাম সেটি নিয়েও বিশেষ প্রশ্ন রয়েছে। এক্ষেত্রে অনেক ভোক্তা ডিম কেজিতে বিক্রি করার দাবী জানিয়েছে। ডিম কেজিতে বিক্রি করলে ন্যায্যতা বাড়বে বলে তারা মনে করেন।

ডিমের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে কিছু ব্যবসায়ী বলছেন, প্রচণ্ড গরমে ডিম নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়। তাছাড়া সম্প্রতি দেশে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় রেমালের কারণে খুলনার দাকোপ, কয়রা, পাইকগাছাসহ উপকূলের বেশ কয়েকটি অঞ্চল লণ্ডভণ্ড হয়েছে। এসব অঞ্চলের অধিকাংশ খামারি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ডিমের উৎপাদন কমেছে। এতে দাম বেড়েছে। তবে যাদের খামারে মুরগি রয়েছে, তারা বর্তমানে লাভবান হচ্ছেন বলে জানান তারা। এই যুক্তি অকাট্য নয়, কারণ, খুলনার বাজারে কমপক্ষে তিন লক্ষ ডিম ঢুকছে বাইরে থেকে।

খুলনা নিউ মার্কেটের তারেক এন্টারপ্রাইজের মোনাদ বলেন, বর্তমানে মাছ ও মাংসের দাম অনেক বেশি। ফলে ডিমের প্রতি ক্রেতাদের ঝোঁক বেশি। হঠাৎ ডিমের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।

খামারিরা জানান, একদিনের বাচ্চা থেকে প্রাপ্ত বয়স হওয়া পর্যন্ত একটা মুরগিতে ৮৫০ টাকা খরচ হয়। মুরগির উপযোগী একটি ঘর তৈরি করতে প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। এছাড়া একটি মুরগি ডিম পাড়ার উপযোগী হতে সময় লাগে সাড়ে চার মাস। এছাড়া খাবারের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় ডিমের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।

খামারিরা বলছেন, ডিম উৎপাদনে ৭০ শতাংশ খরচ হয় খাবারে। আর সেই খাবারের দাম দফায় দফায় বৃদ্ধি পেয়েছে বলে ডিমের দাম বেড়েছে। খাবারের দাম কমলে ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে। স্থানীয় চাহিদা অনুযায়ী শতভাগ সরবরাহ নিশ্চিত করলে সিন্ডিকেটের পতন হবে বলে জানান খুলনার কয়েকজন খামারি। 

পোল্ট্রি খামারি অলোক কুমার বলেন, ‘আমরা খুলনার যত খামারি আছি, সবাই যদি ১০০ ভাগ ডিম সরবরাহ করতে পারি, তাহলে বাইরের সিন্ডিকেট বন্ধ হয়ে যাবে।’ 

খুলনার ডুমুরিয়ার স্বপ্ল পুঁজির খামারি রিমা খাতুন বলেন, একটা সময় এ ব্যবসা লাভজনক ছিল। বর্তমানে যে হারে খাবারের দাম বেড়েছে, খামার চালানোই দুষ্কর। 

দৌলতপুরের রহিম মিয়া বলেন, ‘দীর্ঘ আট বছর ধরে লেয়ার মুরগি পালন ও ডিম নিয়ে ব্যবসা করছি। খরচের ৭০ শতাংশ যায় মুরগির খাবারে। এখন লোকসানের আশঙ্কায় ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছি।’ 

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, দেশে গত ১০ বছরে ডিম ও দুধ উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। এ সময়ে মাংস উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণের কাছাকাছি। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে ডিমের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ১৭ কোটি, যা এখন বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৩৩৮ কোটি। তবে বাজারের অস্থিতিশীলতার কারণে উৎপাদন বাড়ার সুফল পাচ্ছে না সাধারণ ভোক্তারা। 

খুলনা পোল্ট্রি ফিশ ফিড মালিক সমিতির মহাসচিব এস এম সোহরাব হোসেন বলেন, সরকার মুরগির খাবারের দাম কমানোর উদ্যোগ নিলে খামারিরা স্থানীয় পর্যায়ে শতভাগ ডিম সরবরাহ করতে পারবে।

তিনি বলেন, শীর্ষস্থানীয় ১১টি প্রতিষ্ঠান থেকে খামারির চেয়ে ১ টাকা কমে ডিম পাওয়া যায়। ফলে তারা পুরো মার্কেট দখল করে আছে। এছাড়া ঋণসহ সরকারি সুযোগ-সুবিধা এ সব বড় বড় প্রতিষ্ঠান পায়। ফলে তারা একচেটিয়াভাবে বাজার দখল করে আছে। স্থানীয়ভাবে ডিম শতভাগ সরবরাহ করতে পারলে দাম কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসবে। সরকারিভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও মাঝারি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হলে ডিমের বাজারে অস্থিরতা কাটবে। 

তিনি আরও বলেন, কাঁচা বাজার, মাছ বাজার, মুরগি ও গরুর মাংসের বাজারের মতো ডিমের বাজার থাকলে এ সংকট কাটবে। একস্থানে সকল ব্যবসায়ী ও খামামিরা বেচাকেনা করলে দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে।