আম রপ্তানিতে বাংলাদেশের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে

follow-upnews
2 0

বিশ্বের ৯০টিরও বেশি দেশে আম চাষ হয়। গত ত্রিশ বছরের মধ্যে বিশ্বব্যাপী আমের উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে। এশিয়া হচ্ছে আমের উৎস, এবং এশিয়াতেই মোট উৎপাদিত আমের ৭৭ শতাংশ উৎপাদিত হয়। উৎপাদনের দিক থেকে এরপরে রয়েছে আমেরিকা (প্রধানত দক্ষিণ আমেরিকা এবং মেক্সিকো) এবং আফ্রিকা। ইউরোপের দেশগুলোতে খুব কম আম উৎপাদিত হয়। আমেরিকায় মেক্সিকো ও ব্রাজিল সবচেয়ে বড় আম উৎপাদনকারী দেশ। আফ্রিকার প্রধান আম উৎপাদনকারী দেশ হলো নাইজেরিয়া এবং মিশর। আম একটি পচনশীল পণ্য হওয়ায় আম বিক্রি এবং রপ্তানি একটি বড় সমস্যা। বিষমুক্ত আম উৎপাদনে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো আমের পোকা।

আম উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম অবস্থানে থাকলেও রপ্তানি বাজারে অতটা দখল নেই। দেশে বছরে প্রায় ২৪ লাখ টন আম উৎপাদন হয়। তবে পরিবহন, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণে আধুনিক ব্যবস্থা না থাকায় ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ আম নষ্ট হয়ে যায়। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের আমের অনেক চাহিদা রয়েছে। দেশে আমের উৎপাদন অনেক বেড়েছে, রপ্তানির সম্ভাবনাও অনেক। রপ্তানির ক্ষেত্রে আম নিরাপদ ও রোগজীবাণুমুক্ত— এ নিশ্চয়তা দিতে হবে। পাশাপাশি আমের আকৃতি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমের আকার আকৃতি শোভন না হওয়ায় ইউরোপের বাজারে পাকিস্তান, ভারত ও থাইল্যান্ডের তুলনায় পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে ইংল্যান্ড, জাপান, রাশিয়াসহ ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশ থেকে আম আমদানির আগ্রহ দেখিয়েছে। বিশ্বে ২১ জাতের আম রপ্তানি হয়ে থাকে, যার বেশ কয়েকটি বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। এ দেশে সত্তরের বেশি জাতের আম উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে জনপ্রিয় জাত হচ্ছে— খিরসাপাত, গোপালভোগ, লেংড়া, ফজলি, হাড়িভাঙ্গা, আম্রপালি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের দুইটি জাত (খিরসাপাত, ফজলি) জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

আম ভারত, পাকিস্তান এবং ফিলিপাইনের জাতীয় ফল বা ফলের রাজা। সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদিত হয় ভারতে। পৃথিবীর মোট উৎপাদিত আমের অর্ধেকই উৎপাদিত হয় ভারতে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া। পাকিস্তান ষষ্ঠ অবস্থানে, বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। ভারতে সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদিত হলেও আমের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাত্র এক শতাংশ তাদের দখলে। এর প্রধান কারণ- উৎপাদিত আমের বেশিরভাগই তারা অভ্যান্তরীণভাবে খরচ করে। ভা্রতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদিত হয় উত্তর প্রদেশে। দেশে উৎপাদিত মোট আমের প্রায় এক চতুর্থাংশ উত্তর প্রদেশে উৎপাদিত হয। এরপরে রয়েছে অন্ধ প্রদেশ, কর্নাটকা এবং তামিলনাড়ু।  পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আম আমদানী করে চীন, দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ দুই দেশের কোনো দেশেই বাংলাদেশ আম রপ্তানি করে না। চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র প্রায় এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের আম আমদানী করে। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে নেদারল্যান্ড। নেদাল্যান্ডও প্রায় চারশো মিলিয়ন মার্কিন ডলারের আম আমদানী করে। নেদারল্যান্ডেও বাংলাদেশ থেকে আম যায় না। চীন প্রধানত ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মায়ানমার, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, পেরু এবং পাকিস্তান থেকে আম আমদানী করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি আম রপ্তানি করে মেক্সিকো। যুক্তরাষ্ট্রের মোট আমের বাজারের ৬৫% তাদের দখলে। এরপরে রয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার রাষ্ট্র পেরু এবং ইকুয়েডর। নেদারল্যান্ড প্রধানত আম আনে ব্রাজিল থেকে। জার্মান সরাসরি কোনো দেশ থেকে আম আমদানী করে না, এদিক থেকে তারা নেদারল্যান্ডের ওপর নির্ভরশীল। অতএব, আমের প্রাথমিক গন্তব্য হিসেবে নেদারল্যান্ড একটি বড় গন্তব্য। বিশেষভাবে উল্লেখ্য— স্বাস্থ্যবিধি এবং কীটপতঙ্গের সমস্যাগুলির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউভুক্ত দেশগুলোতে ভারতীয় আম নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। অ্যালফোনসো সহ ভারতীয় আমের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ১৯৮৯ সালে আরোপিত একটি আমদানি নিষেধাজ্ঞা এপ্রিল ২০০৭ সালে প্রত্যাহার করা হয়। বাংলাদেশও এ ধরনের একটি অলিখিত নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রয়েছে। 

বিশ্বের প্রধান দশটি আম উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অবস্থান সপ্তম বা  অষ্টম হলেও আম রপ্তানিকারক দেশ হিসাবে কোনো  অবস্থানে বাংলাদেশ নেই। কারণ, রপ্তানিযোগ্য আমের কিছু শর্ত ও বৈশিষ্ট্য থাকা আবশ্যক- যেমন, প্রতিটি আম রোগের জীবাণু, পোকামাকড়, হেভি মেটাল ও দাগ মুক্ত হওয়া প্রয়োজন। তাছাড়া আমের ওজন ২০০-৩৫০ গ্রাম, চামড়া রঙিন, শাঁস দৃঢ় ও মিষ্টতা থাকা বাঞ্ছনীয়। দেশীয় আমে উপরোক্ত বিষয়গুলোর অভাব পরিলক্ষিত হওয়ায় আমগুলোকে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া আম রপ্তানির সঙ্গে সম্পৃক্ত অন্যান্য সমস্যাগুলো নিম্নরূপ-
 

প্রাকৃতিক দুর্যোগ; অল্প সময়ের মধ্যে সকল আম বাজারে চলে আসা; হট ওয়াটার ট্রিটমেন্টের সুবিধা না থাকা। ফলে আম উজ্জ্বল, বেশি দিন স্থায়ী হওয়ার পাশাপাশি ফ্রুটফ্লাই মুক্ত করা যায় না; আম পাকানো ও সংরক্ষণকাল বৃদ্ধিতে ক্ষতিকর রাসায়নিক বস্তুর ব্যবহার; সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা যেমন- প্যাকেজিং ও পরিবহন সন্তোষজনক নয়; কৃষক ও রপ্তানিকারকদের সম্পর্ক না থাকা এবং এ ব্যাপারে সরকারের কোনো উদ্যোগ না থাকা; বিদেশি আমদানিকারকদের আমাদের দেশ সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত না থাকা; গবেষণা ও  সম্প্রসারণ কার্যক্রম যথেষ্ট শত্তিশালী না হওয়া; কোয়ালিটি স্ট্যান্ডার্ড না জানা; ফাইটো স্যানিটারি সার্টিফিকেট নিতে ঝামেলা/হয়রানি/দুর্নীতি; এয়ার কার্গো কম এবং সরকারি সহযোগিতার অভাব; কার্যকর নীতিমালা ও লোন পর্যাপ্ত নয়; যথেষ্ট সংখ্যক উচ্চ শিক্ষিত লোক আম উৎপাদন, সংরক্ষণ এবং রপ্তানি প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত না হওয়া।

বাংলাদেশে উৎপাদিত ৮,৮৯,১৭৬ মেট্রিক টন আমের বেশির ভাগই দেশের ক্রেতারা ক্রয় করে থাকেন। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে সীমিত পরিমাণে আম বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে ল্যাংড়া, ফজলি, হিমসাগর এবং আশ্বিনা জাতের আম রপ্তানি হয়ে থাকে। বারি আম-২ এবং বারি আম-৭ বিদেশে রপ্তানির জন্য সম্ভাবনাময় জাত। তাছাড়া ২০১৫ সাল থেকে ল্যাংড়া, ক্ষীরশাপাতী ও বারি আম-৩ ওয়ালমার্ট-এর চাহিদার তালিকায় রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে আম আমদানিকারক দেশগুলো হচ্ছে যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, সৌদিআরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ওমান। তবে উল্লিখিত দেশের প্রবাসী বাংলাদেশীরাই প্রধানত  এসব আমের প্রধান ক্রেতা। উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতি ও পরিচর্যার মাধ্যমে রপ্তানির উপযোগী আমের উৎপাদন বৃদ্ধি করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এতে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। রপ্তানিযোগ্য আমের উৎপাদন বৃদ্ধিতে করণীয় বিষয়গুলো নিম্নরূপ-

সঠিক পরিমাণ রাসায়নিক সার ব্যবহারের পাশাপাশি বেশি বেশি করে জৈব সারের ব্যবহার বাড়ানো অর্থাৎ জৈব প্রযুক্তি নির্ভর আম উৎপাদনে উৎসাহিত করা। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট জেলায় আম চাষের ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া  দরকার। তাছাড়া রাস্তার দুই ধারে এবং স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে আম গাছ লাগাতে হবে। আগে থেকে জন্মানো গুটি আমের গাছগুলোকে না কেটে টপ-ওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে ভালো জাতে পরিবর্তন করে আমের উৎপাদন বাড়ানো। আম পাকাতে রাসায়ানিকের ব্যবহার বর্জন করা। আমের প্রাপ্তিকাল বাড়াতে হবে, যাতে করে দীর্ঘ সময় ধরে আম পাওয়া যায়। হট ওয়াটার ট্রিটমেন্টের সুবিধা  থাকা। এতে আম উজ্জ্বল, বেশিদিন স্থায়ী হওয়ার পাশাপাশি ফ্রুটফ্লাই মুক্ত হবে। আম সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্যাকিং ও পরিবহন বিষয়ে উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়া। রপ্তানির সাথে সংশ্লিষ্ট আম উৎপাদনকারী, আম সরবরাহকারী এবং আম রপ্তানিকারকদের সরকারি সহযোগিতা প্রদান করা, তাদের নিবন্ধন করা ও সমিতির আওতায় এনে স্বমন্বয় সাধন করা প্রয়োজন। স্থিতিশীল বাজার ব্যবস্থাপনা থাকা দরকার। এ ব্যাপারে জনগণ ও সরকারকে সমান দায়িত্ব নিতে হবে। বিদেশে অনেক দেশে আম চাষি সমিতি আছে— এ সমিতিই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে যাতে করে কোনো চাষি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। আম ব্যবসায়ীদের বিদেশ ভ্রমণের মাধ্যমে আমের আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টি করতে হবে। আম সংরক্ষণের জন্য কোল্ডস্টোরেজ তৈরি, হিমায়িত পরিবহন, দ্রুত স্থানান্তরকরণ, বাছাই, প্যাকেজিং এবং গুণগতমান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকতে হবে। সমবায় ভিত্তিতে আম সংরক্ষণ স্থাপনার ব্যবস্থা করা। অধিক গবেষণা করে বিদেশিদের চাহিদা অনুযায়ী জাত উদ্ভাবন করা।


ফলোআপ নিউজ ডেস্ক

Next Post

ছোটগল্পঃ পুলিশের নাম বসন্ত // সমরেশ মজুমদার

ট্রামবাস চলতে শুরু করে দেয় দুটো নাগাদ, ওই সময় আর কেউই রং ছোড়ে না। তবু অহনা ইতস্তত করেছিল, কালকের দিনটা ছেড়ে দাও। স্বপ্নময় বলেছিল, ইমপসিবল। আগামীকাল বছরের সবচেয়ে বড় চাঁদ উঠবে আর একসঙ্গে দেখব না? তুমি এরকম ভাবতে পারছ? অহনা স্বপ্নময়ের মুখের দিকে তাকাল। তার মনে হল এত আর্তি সে […]
ভারত