এগুলো দুর্ঘটনা নয়, অবহেলা এবং অসতর্কতাজনিত মারনিক ঘটনা

follow-upnews
0 0

২০১২ সালের নভেম্বর মাসে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে ফ্লাইওভারের গার্ডার ধ্বসের ঘটনার কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। ২৪ নভেম্বর ২০১২ তারিখে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে ফ্লাইওভারে গার্ডার ধ্বসে ১৫ জন নিহত হয়। মনে না থাকলে নিচের লিংকটি দেখতে পারেন।

চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙে পড়ে মৃতের সংখ্যা নয় জনে দাঁড়িয়েছে। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক, যাদের মধ্যে কয়েক জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

তখনও একটি তদন্ত কমিটি হয়েছিল। একটি সংসদীয় উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই উপ-কমিটি একই সঙ্গে কালুরঘাট-বহদ্দারহাট সড়কের নির্মাণ কাজের অগ্রগতিও খতিয়ে দেখার কথা ছিল। কেউ কি জানেন ঐ উপকমিটি কী রিপোর্ট দিয়েছিল?

জেলা প্রশাসনও ঐ ঘটনায় ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। তাদের রিপোর্টও জানা যায় না। অন্তত কোনো গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার খবর নেই।

এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটার পর এরকম আরেকটি ঘটনা কেন ঘটবে যদি পূর্বের ঘটনা থেকে কারণ জানা হয়ে থাকে এবং যথেষ্ট সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দায় এবং দায়িত্ব প্রশাসন এবং নির্মাণাধীন প্রতিষ্ঠান মাথা পেতে নেয়?

কিন্তু আবার ঘটেছে। রাজধানীর মালিবাগ রেলগেটে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার পড়ে মানুষ হতাহত হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন এবং এবারও একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে।

কেউ মারা গিয়েছে বলে শুধু জানা গিয়েছে, নইলে এর আগেও একই জায়গায় রাত চারটের সময় গার্ডার ভেঙ্গে পড়েছে! নির্মাণাধীন প্রতিষ্ঠানটি কতটা দয়িত্বহীন হলে একই জায়গায় এরকম ঘটনা দ্বিতীয়বার ঘটে মানুষ হতাহত হতে পারে। স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী পত্রিকার সংবাদ হচ্ছে, গার্ডারটি তোলার সময় পড়েনি, ১৫-২০ দিন আগে তোলা গার্ডারটি রবিবার দিবাগত রাতে পড়েছে। অর্থাৎ দিনে পড়লে হতাহত হতে পারত অনেক বেশি। 

এরকম একটি ঘটনা ঘটার সাথে সাথে নির্মাণাধীন প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের তদারকী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার কথা। কিন্তু ২০১২ সালের ঘটনায় এরকম কোনো মামলা দায়ের হয়নি, এবারও হবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। “কারণ, সর্ষে কখনো ভূতের বিরুদ্ধে মামলা করে না বা ভূত সর্ষের বিরুদ্ধে।” আবার আমরা সাধারণ জনগণ তো বিচারের ভার সৃষ্টিকর্তার ওপর ছেড়ে দিতেই বেশি অভ্যস্থ। তাহলে সমাধান কী?

ডিসকভারিতে “ডেস্ট্রয়েড ইন সেকেন্ড” নামে একটি টেলিভিশন সিরিজ অনেকে হয়ত দেখেছেন। রন পিটস্-এর উপস্থাপনায় আধা ঘণ্টার ঐ অনুষ্ঠানে দেখানো হয়, বিভিন্ন দুর্ঘটনা কীভাবে-কেন ঘটল, ক্যামেরায় ধরা পড়া ফুটেজ চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয় এবং সেখানে থেকে করণীয় নির্ধারণ করা হয়। এখন অবশ্য অনুষ্ঠানটি আর হয় না।

১০২ নম্বর পর্বটির কথা এই মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে। ২০০৮ সালে সম্ভবত ওটি দেখেছিলাম। ওয়াশিংটনের টাকোমা ঝুলন্ত ব্রিজটি ভেঙে পড়ার দৃশ্যটি সেখানে দেখানো হয়। ঐ দুর্ঘটনায় কোনো মানুষ মারা যায়নি, একটি কুকুর নিহত হয়েছিল। কিন্তু ঘটনাটি নিয়ে বিশ্লেষণ-গবেষণা হয়েছিল প্রচুর। এটি নিয়ে গবেষণামূলক টিভি অনুষ্ঠানই “ডেস্টয়েড ইন সেকেন্ডে” র ১০২ নম্বর পর্বটি।

আমেরিকায় ঝুলন্ত ব্রিজ রয়েছে শতাধিক, কিন্তু দুর্ঘটনার নজির ঐ একটিতেই। সদ্য (চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি) অবশ্য ল্যাটিন আমেরিকার দেশ কলম্বিয়ায় একটি ঝুলন্ত ব্রিজ ভেঙ্গে বেশ কিছু লোক হতাহত হয়েছে।

চিলিতে আমার একজন ফেসবুক বন্ধু রয়েছে। তার সাথে আমার দুই দেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হয়। মারিয়া সান্তিয়াগোর সিটি কর্পোরেশনে চাকরি করেন, তাই শহর নিয়েও অনেক কথা হয়। ওখানে ভূমিকম্প বা এরকম কোনো ঘটনার খবর সে আমাকে সাথে সাথে জানায়, এবং আমিও আমাদের দেশের বিশেষভাবে ঘটা ভালো-মন্দ কোনো খবর তাকে জানাই।

২০১৪ সালে পিনাক৬ লঞ্চটি  কয়েকশো যাত্রী নিয়ে মাওয়ায় পদ্মা নদীতে ডুবে গেলে বিষয়টি আমি তাকে জানাই। কিন্তু কোনোভাবেই আমি ওকে বুঝাতে সমর্থ হই না, কীভাবে একটি লঞ্চ নদীতে ডুবে যেতে পারে।সে আমার কাছে জানতে চায়, সমুদ্রে জাহাজ না ডুবলে নদীতে লঞ্চ ডুববে কেন? “আমাদের নদীগুলো তাহলে কী প্রকারের।” এরপর কৌতুহলবশত সে আমাদের লঞ্চ চলাচলের কিছু ফুটেজ চায়। ঐ ঘটনার ফুটেজ সে নিজ থেকেই ইউটিউবে দেখে আমাকে বলেছে, “এটি নিশ্চয়ই আর কখনো ঘটবে না।” কিন্তু তারপরও ঘটেছে এবং আমি জানি হয়ত আবারো ঘটবে!

মাওয়ায় স্পিডবোট দুর্ঘটনার খবর প্রায়ই শোনা যায়। মাত্র কয়েকদিন আগেও দুইজন মারা গিয়েছে। ৮-৯ বছর আগে, আমেরিকা প্রবাসী আমার এক বন্ধুর সাথে স্পিডবোটে মাওয়া থেকে পদ্মা পার হচ্ছিলাম। ছোট্ট স্পিডবোটে ঠেসে যাত্রী ভরে যে গতিতে চালাচ্ছিল তাতে মনে হচ্ছিল যে কোনো সময় তা উল্টে যেতে পারে বড় কোনো ঢেউয়ের ধাক্কায়। বন্ধুটি আমাকে বুঝিয়েছিল, এক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা যদি ০.০১% ও হয়, তাহলে প্রতি এক হাজার ট্রিপে একটি দুর্ঘটনা ঘটবে। প্রতিটি দুর্ঘটনায় হয়ত কেউ মারা যায় না, মারা গেলে সেটি খবর হয়। অাবার অনেক সময় খবর হয়ও না।

বিষয় হচ্ছে, দুর্ঘটনা কখনো রোধ করা যাবে না, যদি দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যে নামিয়ে আনা না যায়। যদি এমন হত এবং এমনভাবে স্পিডবোটগুলো মাওয়া ঘাটে পরিচালনা করা হত যাতে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা একেবারেই গাণিতিক যুুক্তির অন্তর্ভুক্ত নয়, তাহলে দুর্ঘটনাটিকে আদৌ দুর্ঘটনা বলা যেত। কিন্তু যেহেতু পরিচালনা দেখেই বলে দেওয়া যায় যে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, তার মানে এগুলো দুর্ঘটনা নয়, অসতর্কতাজনিত মারনিক ঘটনা।

ফ্লাইওভারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হতে বাধ্য, এই বুঝি কিছু একটা ছিটকে এসে মাথায় পড়ল! কারণ, খোলাচোখেই দেখা যায়, যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা সেখানে নেই। ক্রেন ধ্বসে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা এই শহরে আছে। তারপরও মেশিন এবং কানস্ট্রাকশন মেটেরিয়ালগুলো এমনভাবে ফ্লাইওভারের আশেপাশে থাকে তাতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে যে কোনো সময়।

ফ্লাইওভার রোজ তৈরি হবে না, কিন্তু গোটা পাঁচেক  ফ্লাইওভার তৈরি করতে ইতোমধ্যে গোটা দশেক ছোটবড় দুর্ঘটনা ঘটে গেছে আমাদের দেশে! একইরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। মালিবাগের ফ্লাইওভারের গার্ডার ধ্বসে পড়ার চিত্রটিও হয়ত আশেপাশের কোনো ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় ধরা পড়ে থাকবে। সেটি সংগ্রহ করলে কারণ উদঘাটন করা সহজ হবে। অবশ্য সবচে’ বড় কারণ তো সহজেই অনুমেয়- অদক্ষতা, অসতর্কতা, নিয়মিত মনিটরিং-এর অভাবেই এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে থাকে।

আকাশে বিমান দুর্ঘটনার অজানা অনেক কারণ থাকতে পারে, তারপরেও অতি আশ্চর্য কোনো কারণ খুব বেশি কখনো দেখা যায় না। ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙ্গে পড়ার এমন কোনো মহাজাগতিক কারণ কি থাকতে পারে, যা তদন্ত কমিটি খুঁজে পাবে না দীর্ঘদিন তদন্ত করেও?

Next Post

রাইটার্স ইউনিয়নের মাসিক সাহিত্য আড্ডা : চলেন ঘুরে আসি কাছে-দূরে বন্ধূত্বে; গল্পে-গানে-কবিতায়

ফোন করুণ : ০১৭২৮ ৪৩১৮৮০