সদ্য প্রয়াত রাষ্ট্রদূত, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েস-এর স্মৃতিচারণ করেছেন ড. শেখ বাতেন

follow-upnews
0 0

কায়েস আসবে না। কায়েসের লাশ আসবে ঢাকায়। যাবার সময় ওর ব্যবহার করা টেলিভিষনটা দিয়ে গেছিল আমাকে। ওটা অনেকদিন ধরে সচল নয়। আমি টিভি দেখি না বলে তার মুত্যর খবর জানলাম ফেসবুকে। কায়েসের সঙ্গে পেশাগত পরিচয়টা আকস্মিক। মানুষ হিসাবে বন্ধুত্বের পরিচয়টা মৌলিক। ও আমার কবিতার অনুবাদ করেছে। বইযের ভূমিকা লিখেছে। আমরা অনেকে অনেকভাবে তার সাথে জড়িয়ে ছিলাম, এখন টের পাওয়া যাবে। ছিড়ে না গেলে কি টের পাওয়া যায়? একজন বন্ধুর মুত্যু মানে নিজের আংশিক মুত্যুও বটে। যদিও কায়েসের বসয় বেশি ছিলো না।


মিজারুল কায়েসঃ লাশের মুখের মতো প্রেম

আমাদের বন্ধু মিজারুল কায়েস আজ ব্রাজিলের একটি হাসপাতালে মারা গেছেন! কবি ইকবাল আজিজ জানালো। নিশ্চিত হলাম। কিন্তু এ নিয়ে আমি কী করে লিখি? আমার আঙ্গুল কাঁপছে। এই প্রথমবারের মতো, কিছু লিখতে গিয়ে আমার হাতও কাঁপছে।

খুব সামান্য অভিমানে কিংবা হতে পারে দেশের বাইরে থাকার কারনে, ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ কম হচ্ছিলো। অথচ প্রায় রোজই খবর রাখতাম। জীবনের বড় একটা অংশে ওর সাথে জড়িয়ে ছিলাম। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রেে এবং সিভিল সার্ভিসে, সমানভাবে। অারো অনেকভাবে। যা বলা যায় না। সব স্মৃতির আনুষ্ঠানিক মুল্য নেই। মানুষটি না থাকলে সেগুলো অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে মনে পড়ে।

একবার মানিকগঞ্জ যাবো ঘুরতে। সিদ্ধান্ত হলো, মাঝে ধামরাই বাজার থেকে তরমুজ কিনে খাওয়া হবে। এক সময় আমি এখানকার ম্যাজিষ্ট্রেট, ও ছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের পরিচিত মুখ। এভাবে আমাদের হাটের দিন খোলা জায়গায় খাওয়াটা ঠিক হবে কিনা ভাবছি। দেখি, ও একাই আস্ত এক কামড়ে তরমুজ শেষ করে দিচেছ। আমি আশাহত হলাম। কিন্তু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মাফ করে দিই। ঢাকার পুরান টাউনে কতো বাখরখানি বিক্রেতা যে ওকে চেনে! তাদের চুলার ভেতর হাতা ঢুকিয়ে খাবার তুলে খেয়ে নিত ও। খাওযার ব্যপারে ওকে ছাড় না দিয়ে উপায় নেই।

অনেক কথা শুনতে পাচিছ। তাই বলতে হচ্ছে, সবচেয়ে অমায়িক, সর্বোচ্চ মাপের শিক্ষিত, একাত্তরের জনযুদ্ধের প্রতি আদর্শিক কারনে শ্রদ্ধশীল -এ জাতীয় রাষ্ট্রীয় কর্মকতা এই রাষ্ট্রে বেশি নেই। সেই মানুষটার ভোগান্তি কম হয়নি। সে কি তার নিজের দোষে? কখনো কখনো কিছুটা তা আমার দোষেও হয়েছিলো বটে।

আমি নিউইয়র্ক স্টেট ইউনিসিটিতে পিএইচডি প্রো্গ্রামের শেষ দিকে। দেশে সরকার বদলে গেলো, বেগম খালেদা জিয়া আসলো। রাজনীতির নেতারা অন্তরালে। আমরা যারা রাষ্ট্রীয় কর্মকতা আড়ালে পালাতে পারি না, আড়াল করার মতো কোনো অপরাধও করিনি বলে, কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর ওরা কুকুরের মতো আমার ওপর কামড় বসালো। সে বিষ আজও ছাড়াতে পারিনি। চাকরিতে যোগদান করতে দেয়নি; বাসায় আক্রমন করে বসে… এমন অনেক কিছু।

কায়েস তখন পররাষ্ট্র মান্ত্রনালযের ‘নগন্য ডিরেকটর’। তার চাকরির অবস্থাটাও ভালো না। তখন পররাষ্ট সচিব ছিলেন শমসের মবিন চৌধুরী । যে ঝড়ের সময়টায় ওর নিজের মাথার ওপরই ছাতা নেই, সে সময় আমার মাথার ওপর ছাতা মেলে ধরেছে সাধ্যমত। কী লাভ ছিল তার? কিছুই না।

কিছু ঝামেলা কায়েস নিজেই তেরি করেছে সব সময় শুধু সেগুলো করা উচিৎ বলে। আমার মতো, জাতিয়তাবাদী আমলে তার বিরুদ্ধে অভিয়োগ ছিল ও আওয়ামী লীগার। কী রকম? সে সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালযে কায়েসের অফিস রুমের দেয়ালে এক “ভয়ংকর মানবের” বড় একটা পোট্রেট ঝুলানো ছিলো। তার চেয়ে ভয়ংকর হলো, কতৃপক্ষ বলার পরও, কায়েস ওটা দেয়াল থেকে নামাতে রাজি হচিছলো না। কায়েস আমাকে বোঝাতে চাইছিলো, এটা শেখ মুজিবের অফিশিয়াল ছবি তো নয়, একজন শিল্পির আঁকা শিল্পকর্ম। সেটা তো অামি রাখতেই পারি, অফিশিযাল নিয়মেই পারি। পরে বললো, আমি একটা বুদ্ধি করলাম। কী? তাদেরকে বললাম, আমার রুমটা বদলে দাও। আমি নিজে তো নামালাম না। নিজের ডি্পলোম্যটিক বুদ্ধির প্রশংসা করে আমার মুখের দিকে তাকায় ও! আমার বরং ক্রোধ অাসে। আমি অন্যায় আদেশে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠি, সে তা মোকাবেলা করে অন্যভাবে। নিজের দুর্ভাগ্য নিয়ে রসিকতা করার বিরল গুণ আমার নেই।

বলা দরকার, আমরা যারা আদর্শিক কারনে মুক্তিযুদ্ধকে লালন করি তাদের কাছে সব বিষয়ে আনুগত্য আশা করা যায় না । উচিৎ নয়। এই মানুষগুলোর মানসিক গড়ন ভিন্নতর হয়। আপনার সব গান আপনি তাদের দিয়ে গাওয়াতে পারেন না।

আমি জানি, এ অসুস্থ কর্মকর্তাকে লন্ডন থেকে সরে যেতে হযেছিলো। সবটা জানি না। আমি কিছু বলেবো না এখানে। তবে এটা বলা উচিৎ, দ্বিতীয় শ্রেণির ব্যক্তিরা প্রথম শ্রেণির দায়িত্ব নিয়ে বসে আছে রাষ্ট্রের অনেক জায়গায়। কই তাদের নিয়ে তো প্রশ্ন তুলছেন না? যখন স্পষ্ট করে জানি, জামাত বিএনপি লোকেরা টাকা দিয়ে ভালো পোষ্টিং যোগাড় করে নিযেছে। স্বাধীনতা বিরোধীরা কোটি টাকার প্রকল্প উদবোধন করতে যাচেছ রাষ্ট্রীয়ভাবে। কিছু তো বলছেন না? অসহ্য লাগে। সরকার পরিবর্তনে তাদের কিছুই হয় না । সে সময়ে স্বাধীনতার লোক বলে যারা আমাদের পেশাগত অস্তিত্বে কামড় বসিয়েছিলো, এখনও তারা দাঁতের ধার দেখাচ্ছে। তাদের নিরাপদে ভালো রাখা হয়েছে। আমাদের রাখা হচ্ছে দুরে! এর মাসুল অনেকভাবে দিতে হচেছ, না দিয়ে ‍উপায় নেই।

কায়েস আসবে না। কায়েসের লাশ আসবে ঢাকায়। যাবার সময় ওর ব্যবহার করা টেলিভিষনটা দিয়ে গেছিল আমাকে। ওটা অনেকদিন ধরে সচল নয়। আমি টিভি দেখি না বলে তার মুত্যর খবর জানলাম ফেসবুকে। কায়েসের সঙ্গে পেশাগত পরিচয়টা আকস্মিক। মানুষ হিসাবে বন্ধুত্বের পরিচয়টা মৌলিক। ও আমার কবিতার অনুবাদ করেছে। বইযের ভূমিকা লিখেছে। আমরা অনেকে অনেকভাবে তার সাথে জড়িয়ে ছিলাম, এখন টের পাওয়া যাবে। ছিড়ে না গেলে কি টের পাওয়া যায়? একজন বন্ধুর মুত্যু মানে নিজের আংশিক মুত্যুও বটে। যদিও কায়েসের বসয় বেশি ছিলো না।

কী জানি কী অদ্ভুত কারনে আমাদের প্রিয় ও চমৎকার মানুষগুলো বাংলাদেশে ঠিকমত শ্বাস নিতে পারছে না। কাযেসের মতো মানুষ তো শ্বাসকষ্টেই মারা যাবে। এটাই স্বাভাবিক। এই নষ্ট স্বাভাবিকতা, মানি না। এই বৃত্ত ভাঙতে হবে।

কী কারনে গতকালের লেখা দুটো বিমূর্ত লাইন আজকেই প্রাসঙ্গিক হয়ে গেলো । মানুষের অনুভবে সত্যি কি প্রিয় মানুষের মৃত্যুর আগাম খবর আসে ? —

দেখা হযে যাবে এই ভয়ে কতোবার রয়েছি লুকায়ে
লাশের মুখের মতো প্রেম —

ড. শেখ বাতেন ১১.০৩.২০১৭

Next Post

বঙ্গবন্ধুর বিরল ভিডিও : যেখানে শিশু শেখ রাসেলকে নাস্তা খেতে বলছেন তিনি

আমার দেখা শ্রেষ্ঠ ভিডিও। নিজে দেখুন , শিয়ার করে বন্ধুদের দেখার সুযোগ করে দিন প্লিজ। Posted by Video Records on Tuesday, August 18, 2015