গণমানুষের শক্তি: এক ঘণ্টায় আড়াই লক্ষ গাছ লাগিয়েছে এলাকাবাসী

follow-upnews
0 0

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিলুফা সুলতানার চোখের কোণে পানি। তাঁর বিশ্বাস হচ্ছিল না, এই অসাধ্য তিনি সাধন করেছেন। তাঁর কয়েক মাসের নিরলস চেষ্টাকে ছাপিয়ে তারাগঞ্জের সাধারণ মানুষ তাঁর সামনে আবির্ভূত হয়েছেন সত্যিকারের তারকা হিসেবে। তাঁরা এক ঘণ্টায় আড়াই লাখ গাছের চারা রোপণ করেছেন উপজেলার ১৫৩টি রাস্তায়। বাংলাদেশে নির্দিষ্ট সময়ে গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে এটা হয়তো একটি রেকর্ড। কিন্তু রেকর্ডের চিন্তাকে ছাপিয়ে গেছে সাধারণ মানুষের আবেগ, যা উৎসবে রূপ নিয়েছিল রংপুরের নিভৃত এই উপজেলাজুড়ে।
গতকাল বৃহস্পতিবার ভোরে ফজরের নামাজ শেষে পরিকল্পনামতো উপজেলার সব মসজিদের মাইক থেকে গাছ লাগানোর আহ্বান জানানো হয় উপজেলাবাসীকে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বাজতে থাকে দেশাত্মবোধক গান। রঙিন কাগজ বাঁধা ফিতায় ঘেরা রাস্তাঘাট। চারদিকে উৎসবের আমেজ। হাজারো মানুষ পায়ে হেঁটে কোদাল, পাসুন, খুন্তি নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে। এসেই সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে রাস্তার পাশে। ঘড়ির কাঁটা সাতটার ঘরে পৌঁছামাত্র তত্ত্বাবধায়কেরা বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে ড্রামে শব্দ তুললেই গর্ত খুঁড়ে গাছের চারা লাগানো শুরু করে আবালবৃদ্ধবণিতা। ঘড়ির কাঁটা আটটায় পৌঁছালে ফের তত্ত্বাবধায়কেরা বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে ড্রাম বাজালে রোপণ বন্ধ করা হয়। এভাবে ১ ঘণ্টায় আড়াই লাখ গাছের চারা রোপণ করে তারাগঞ্জবাসী।
আড়াই লাখ গাছ লাগানোর কারণ হিসেবে ইউএনও জিলুফা সুলতানা বলেন, এক ঘণ্টায় ২ লাখ ২৩ হাজার ৩৯০টি গাছ লাগিয়ে গিনেস রেকর্ড করেছে ফিলিপাইন। তিনি এই সংখ্যাটা ছাড়িয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নেন, যার নাম ‘সবুজ তারাগঞ্জ গড়ি’।
আয়োজকেরা জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩০ হাজারের বেশি মানুষ অংশ নেন এই বৃক্ষরোপণে। মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ কোদাল, খুন্তি হাতে গাছের চারা রোপণের উৎসবে মেতে ওঠেন। উপজেলার ১৫৩টি রাস্তায় ৪৬০ কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে তাঁরা চারা রোপণ করেন।
এর আগে প্রস্তুতি হিসেবে পাঁচ ইউনিয়নের ৪৫টি ওয়ার্ডে সভা করা হয়। জনপ্রতিনিধি, ইমাম, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, কৃষকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ তাতে অংশ নেন। এরপর কয়েক হাজার মানুষকে নিয়ে মহড়া দেওয়া হয় গাছ লাগানোর। প্রতি ৫০ জন শিক্ষার্থী একজন তত্ত্বাবধায়কের অধীনে চারা রোপণের প্রস্তুতি নেন।
বৃক্ষ রোপণে অংশ নেওয়া লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৩১ আগস্ট ১৫৩টি রাস্তায় ট্রাক, ট্রলি, রিকশাভ্যানে করে আড়াই লাখ গাছের চারা নিয়ে যাওয়া হয়। ওই দিন বিকেল সাড়ে চারটায় রাস্তার ধারে হাজারো মানুষ বৃক্ষ রোপণের মহড়া দেন। মহড়া শেষে রশিতে সাত রঙের কাজ দিয়ে ওই রাস্তাগুলো ঘিরে দেওয়া হয়।
সদর উপজেলার সরকারপাড়া গ্রামের দিনমজুর দেলোয়ারের স্ত্রী মর্জিনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রামের সউক আস্তাত হামাক দিয়া গাছ নাগাইল ইউএনও। গাছোত ফল হইলে হামার উপকার হইবে। গাছের ছায়াত হামরা আরাম করমো। ফলও খামো।’
বরাতি উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী হোমায়রা খাতুন বলল, ‘ভোরে ঘুম থাকি উঠি রাস্তায় আসছি। বাঁশিতে ফুঁ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাছ লাগানো শুরু করি। এক ঘণ্টায় প্রায় ২০টা গাছ লাগাইছি।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, আম, কাঁঠাল, আতা, বেল, জলপাই, জামরুল, লটকন, শরিফা, সফেদা, চালতা, গোলাপজাম, জাম্বুরা, ডেউয়া, নারকেল, আমড়াসহ নানা ধরনের ফলের গাছ লাগানো হয়েছে। ফুলের গাছের মধ্যে আছে পলাশ, রাধাচূড়া, সোনালু, মিনজিরি, কদম, শিমুল, কৃষ্ণচূড়া, জারুল, কামিনী, বকুল, বাগানবিলাস, হৈমন্তী, শিউলি, স্থলপদ্ম, নীলকাঞ্চন, অশোক। ঔষধি গাছের মধ্যে আছে আমলকী, হরীতকী, বহেড়া, জাত নিম, অর্জুনসহ বিভিন্ন প্রজাতি। ৪০ জাতের আড়াই লাখ চারা সংগ্রহ করে রোপণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
উপজেলার মধ্যে রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের শলেয়া শাহবাজার থেকে আলমপুর বাজার পর্যন্ত তারাগঞ্জের ১৬ কিলোমিটার অংশের দুপাশে তিন সারিতে পাঁচ ফুট পর পর ৪৩ হাজার গাছের চারা রোপণ করা হয়। প্রথম সারিতে ফুল, দ্বিতীয় সারিতে ফল ও তৃতীয় সারিতে ঔষধি গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। বছরের যেকোনো ঋতুতে কোনো না কোনো ফল, ফুল পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ইকরচালী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই মহৎ উদ্যোগের জন্য ইউএনও স্যার আমাদের কাছে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এ কাজে যুক্ত থাকতে পেরে আমরা সত্যি ধন্য।’
ইউএনও জিলুফা সুলতানা বলেন, গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর তিনি তারাগঞ্জে যোগদান করেন। একদিন বিকেলবেলায় উপজেলা পরিষদ চত্বরের সরকারি বাসার ছাদে উঠে দেখেন চারদিকে নানান গাছপালা। ভাবলেন এমন যদি হতো, উপজেলার প্রতিটি রাস্তা সারিবদ্ধ গাছে শোভিত, তাহলে মানুষের চোখ জুড়িয়ে যেত।
পরদিন সকালে ইউএনও উপজেলা নার্সারি সমিতির সভাপতি আব্দুল গফফারকে তাঁর দপ্তরে ডাকেন। কিছু ফল, ফুল ও ঔষধি গাছের চারা কিনে বাসার সামনে লাগান। আর পুরো উপজেলাকে সবুজে ভরে দেওয়ার জন্য উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। তাঁরা সাড়া দিলে তিনি উপজেলা পরিষদ চত্বরে ১০ হাজার জলপাইয়ের চারা করার উদ্যোগ নেন।
আস্তে আস্তে পরিকল্পনা গুছিয়ে নিয়ে ইউএনও তাঁর উদ্যোগের কথা রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার কাজী হাসান আহমেদকে জানান। জানান জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার, তারাগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমানকে। তাঁরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন।
শুরু হয় কাজ। চারা সংগ্রহ, চারা রোপণ, খুঁটি সংগ্রহ, উপকারভোগী নির্বাচন, উপকারভোগীর চুক্তিপত্র সম্পাদন, পরিচর্যা—সব মিলে ১৮টি কমিটি করা হয়। এসব কমিটির সদস্য ৮২০ জন। কমিটিগুলো নিজ নিজ দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করায় সফল হয় গাছ লাগানোর এই মাহযজ্ঞ। সকালে ফিতা কেটে গাছ লাগানো উদ্বোধন করেন রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার কাজী হাসান আহমেদ। জেলা প্রশাসক, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য সবাই উপস্থিত ছিলেন এই আনুষ্ঠানিকতায়।
উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মাহামুদা বেগম বলেন, এই উদ্যোগ অনুকরণীয় ও দৃষ্টান্তমূলক। ঘণ্টায় আড়াই লাখ গাছের চারা রোপণ করে তারাগঞ্জবাসী এই উপজেলাকে সারা দেশের কাছে পরিচিত করে তুলল।
জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার ইউএনওর প্রশংসা করে মুঠোফোনে বলেন, ‘এ কাজ সারা দেশে অনন্য নজির হয়ে থাকবে।’
সয়ার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আজম বলেন, পাঁচটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের নেতৃত্বে গ্রামে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে বাঁশ সংগ্রহ করে খুঁটি তৈরি করা হয়। হাজারো মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে রাস্তায় গাছ রোপণের পর খুঁটি লাগিয়ে দেন।
চারা রোপণ শেষে ইউএনও জিলুফা সুলতানা বলেন, ‘প্রভাতফেরি করার মতো করে ৩০ হাজারের বেশি সুশৃঙ্খল মানুষ রাস্তায় নেমে আসল। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য, যা আমাদের কল্পনাকে ছাড়িয়ে গেছে। স্নিগ্ধ সকালে গ্রামের ১৫৩টি রাস্তায় ২ লাখ ৫০ হাজার গাছের চারা রোপণ—এ যেন এক সবুজ সূর্যোদয়ের গল্প। কতগুলো ফুলেল রঙিন মেঠোপথের যে স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, তার যাত্রা আজ শুরু হলো। তারাগঞ্জ হোক আমাদের স্বপ্নের উন্মুক্ত উদ্যান।’ আবেগতাড়িত ইউএনও আরও বললেন, ‘কোনো ছবি দিয়ে, লেখা দিয়ে আজকের (গতকালের) এই উৎসবকে বর্ণনা করা যাবে না। আবেগ দিয়ে অনুভব করতে হবে। বারবার মুখে চলে আসছে আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’

সূত্র: প্রথম আলো

Next Post

"একটি বন্দুকের লাইসেন্স চাই, মাননীয় সরকার"

একা নারীর অসহায়ত্ব, লিঙ্গভেদ এবং আত্মঘাতি সামাজিক বৈষম্য গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আমি একজন সরকারি চাকুরিজীবি, ডাক্তার। একটি উপজেলায় পোস্টিং। একটি বন্দুকের লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে চাই সরকারের কাছে। প্রথম কারন, উপজেলায় কর্মরত অবস্থায় আমার নিরাপত্তা নেই, স্থানীয় কিছু লোকজন তাদের ইচ্ছামত চিকিৎসা না করলে, অন্যায় আবদার না রাখলে, বা খারাপ […]

এগুলো পড়তে পারেন