পুড়িয়ে মেরেও চাকরিতে বহাল!

follow-upnews
0 0

ঘটনাস্থলে চা-দোকানির শরীরে আগুন জ্বললেও শাহ আলী থানার পুলিশ আগুন নেভানোর বা তাঁকে হাসপাতালে পাঠানোর উদ্যোগ নেয়নি।

রাজধানীর মিরপুরে চা-দোকানি বাবুল মাতবরকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় পুলিশের তদন্ত কমিটি শাহ আলী থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) পুলিশের পাঁচ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার সুপারিশ করেছিল। তবে ওসি এ কে এম শাহীন মণ্ডল ও কনস্টেবল জসিমউদ্দিনকে এ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। বিভাগীয় মামলায় অন্য তিনজনকে ‘গুরুদণ্ড’ (বিভিন্ন মেয়াদে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি কর্তন) দেওয়া হয়। পুলিশের এই পাঁচ সদস্যই বর্তমানে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন।
এদিকে ওই ঘটনায় করা হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত দুই আসামির একজন জামিনে আছেন এবং অন্যজনকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
পুলিশের পাঁচ সদস্যের চাকরিতে যোগদানের খবরে এবং মামলার তদন্তে অগ্রগতি না হওয়ায় হতাশ নিহত বাবুলের পরিবারের সদস্যরা। তাঁরা বলছেন, দায় থাকা সত্ত্বেও পুলিশ সদস্যদের এভাবে ছাড় দেওয়াটা তাঁরা মেনে নিতে পারছেন না।
পরিবারের অভিযোগ, গত ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে শাহ আলী থানার পুলিশের চার সদস্যের উপস্থিতিতে তাঁদের সোর্স (তথ্যদাতা) দেলোয়ার হোসেন মিরপুর ১ নম্বরের গুদারাঘাটের কিংশুক সমবায় সমিতির কার্যালয়-সংলগ্ন ফুটপাতের চা-দোকানি বাবুল মাতবরের কাছে চাঁদা দাবি করেন। বাবুল চাঁদা না দেওয়ায় দেলোয়ার তাঁকে লাথি মারলে তিনি কেরোসিনের জ্বলন্ত চুলার ওপর পড়ে যান। এতে বাবুল দগ্ধ হন এবং পরদিন দুপুরে হাসপাতালে তিনি মারা যান।
এ ঘটনায় পুলিশের মিরপুর বিভাগের পক্ষ থেকে ওই বিভাগের তৎকালীন অতিরিক্ত উপকমিশনার মাসুদ আহাম্মদকে ও ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া উপকমিশনার টুটুল চক্রবর্তীকে (শৃঙ্খলা) প্রধান করে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। ওই ঘটনায় শাহ আলী থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) মমিনুর রহমান খান, নিয়াজউদ্দিন মোল্লা, এএসআই দেবেন্দ্র নাথ, কনস্টেবল জসিমউদ্দিনকে সাময়িক বরখাস্ত এবং ওসি শাহীন মণ্ডলকে প্রত্যাহার করা হয়।

সূত্র বলেছে, গত ফেব্রুয়ারিতেই পুলিশের দুই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ডিএমপি কমিশনারের কাছে জমা দেওয়া হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাবুল অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় গড়াগড়ি করলেও ঘটনাস্থলে উপস্থিত এসআই মমিনুর, এএসআই দেবেন্দ্র ও কনস্টেবল জসিমউদ্দিন আগুন নেভাতে যাননি। তাঁরা বাবুলের শরীরের আগুন নিভিয়ে হাসপাতালে নিলে হয়তো বাবুল বেঁচে যেতেন। তাঁরা সহায়তা চেয়েও যোগাযোগ করেননি। ঘটনার সময় শাহ আলী থানায় কর্তব্যরত এসআই নিয়াজউদ্দিন মোল্লা ঘটনা জেনেও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি কিংবা সংকট সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেননি। আর থানার প্রধান হিসেবে ওসি শাহীন মণ্ডল পুলিশের ওই দলের খোঁজ রাখেননি কিংবা তদারকও করেননি। ঘটনা জানার পরও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তাঁর ঘাটতি ছিল। দুই কমিটিই পুলিশের এই পাঁচ সদস্যের বিরুদ্ধে কর্তব্যে গাফিলতি বা অবহেলা ছিল উল্লেখ করে তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করার সুপারিশ করে।

মাসুদ আহাম্মদ বর্তমানে মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার। গত রোববার যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ঘটনাস্থলে চা-দোকানির শরীরে আগুন জ্বললেও শাহ আলী থানার পুলিশ আগুন নেভানোর বা তাঁকে হাসপাতালে পাঠানোর উদ্যোগ নেয়নি। ওসি এর দায় এড়াতে পারেন না। সেদিনের ঘটনায় ওসিসহ পাঁচ পুলিশের বিরুদ্ধে কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করার সুপারিশ করা হয়েছিল।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সদর দপ্তর বলেছে, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের অভিযোগের ধরন দেখে ওই পাঁচ পুলিশ সদস্যকেই কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। নোটিশের সন্তোষজনক জবাব পাওয়ায় শাহীন মণ্ডল ও জসিমউদ্দিনকে বিভাগীয় মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। অপর তিনজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয় এবং তাঁদের ‘গুরুদণ্ড’ দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে মমিনুর রহমানের আগামী পাঁচ বছরের ইনক্রিমেন্ট (বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি) কর্তন, নিয়াজউদ্দিনের দুই বছরের এবং দেবেন্দ্র নাথের এক বছরের ইনক্রিমেন্ট কর্তন করা হয়েছে।

পুলিশ প্রবিধানে গুরুদণ্ড হলো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বেতন কর্তন ও বেতন বৃদ্ধি বন্ধ রাখা, চাকরি থেকে অব্যাহতি, ব্ল্যাক মার্ক করা ও পদাবনতি করা। আর লঘুদণ্ড হলো সতর্ক করা ও তিরস্কার করা। পুলিশের অধ্যাদেশে একে সাজা হিসেবে ধরা হয়।

ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মো. মাসুদুর রহমান রোববার বলেন, দোষী প্রমাণিত হওয়ায় তিন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয় এবং বিচার শেষে তাঁদের গুরুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলেছে, ওই পাঁচ পুলিশ সদস্য সম্প্রতি কাজে ফিরেছেন। তাঁদের মধ্যে শাহীন মণ্ডল বর্তমানে ভোলার তজুমুদ্দিন থানার ওসি ও এসআই মমিনুর পাবনায় কর্মরত। অন্য তিনজন ঢাকার বাইরে পুলিশের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত।

২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় যোগাযোগ করা হলে শাহীন মণ্ডল বলেন, ‘তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দেওয়ার পর ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয় থেকে আমাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, চা-দোকানি বাবুল অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ঘটনায় আমার তদারকির অভাব ছিল।’ তিনি বলেন, ‘আমি নোটিশের সন্তোষজনক জবাব দেওয়ায় কর্তৃপক্ষ বিভাগীয় মামলা থেকে আমাকে অব্যাহতি দেয় এবং চাকরি বরিশাল রেঞ্জে ন্যস্ত করে। সেখান থেকে আমাকে গত এপ্রিলে তজুমুদ্দিন থানার ওসি হিসেবে বদলি করা হয়।’

হতাশ বাবুলের পরিবার: পুলিশের পাঁচ সদস্যের আবার চাকরিতে বহাল হওয়ার খবর শুনে হতাশ নিহত বাবুল মাতবরের পরিবার। পরিবারটির দিন কাটছে খুব কষ্টে।

নিহত বাবুলের পুত্রবধূ মণি আক্তার বলেন, ‘পুলিশের কারণে আমার শ্বশুর খুন হইছে। আমরা পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করতে চাইছিলাম। কিন্তু থানার ওসি সেই মামলা নেননি। পরে পুলিশ কম্পিউটারে টাইপ করে তাতে আমার ননদ রোকসানার সই নেয়। তা আমাদের পড়ে শোনানো হয়নি। ওই মামলায় পুলিশের সোর্স ও স্থানীয় কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ীকে আসামি করা হয়। এজাহারভুক্ত এক আসামি মাদক ব্যবসায়ী পারুল বেগম তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই জামিনে বেরিয়ে গেলেন। এজাহারভুক্ত আরেকজন পুলিশের সোর্স (তথ্যদাতা) দেলোয়ার হোসেন চার মাসেও ধরা পড়ল না।’

মণি আক্তার বলেন, শ্বশুরের মৃত্যুর শোক না কাটতেই ১৩ জুন তাঁর শাশুড়ি মারা গেছেন। তিনি অবুঝ এক মেয়ে ও এক ছেলে রেখে গেছেন। তখন ওই মেয়ের বয়স ছিল দুই মাস। শ্বশুর হত্যা মামলার তদন্তের বিষয়ে জানতে ফোন করলে তদন্তের দায়িত্বে থাকা ডিবি শুধু বলে, তদন্ত চলছে, ভালোমতো দেখছে।

পারিবারিক সূত্র বলেছে, বাবুল মাতবর জীবিত থাকাকালে ডায়াবেটিস, ক্যানসার ও হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত স্ত্রী লাকি আক্তারের চিকিৎসা করাতেন। বাবুল মারা যাওয়ার পর টাকার অভাবে তাঁর চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলে রাজু রিকশা চালিয়ে যা পান, তা দিয়ে সাত-আট সদস্যের পরিবারটির অনেক কষ্টে দিন কাটছে। আত্মীয়স্বজনের সাহায্যের টাকা দিয়ে মেয়েটির জন্য গুঁড়া দুধ কেনা হচ্ছে। বাবুলের দোকানটি দুদিন খোলা হলেও ভয়ে মানুষ আসেনি। ঘটনার পর তৎকালীন জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন মিয়া আশ্বাস দিলেও সিএনজিচালিত অটোরিকশাটি এখনো তাঁরা পাননি।

বাবুল হত্যা মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির উপকমিশনার (পশ্চিম) মো. সাজ্জাদুর রহমান বলেন, বাবুল হত্যায় পুলিশের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তবে এজাহারভুক্ত আসামি দেলোয়ার পলাতক রয়েছেন। তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পাঁচ পুলিশ সদস্যের দায়িত্বে অবহেলা থাকলেও তাঁরা ফৌজদারি অপরাধে জড়িত, এমন তথ্য পাওয়া যায়নি।

সূত্র: প্রথম আলো

Next Post

অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ভবিষ্যত // ড. তাপস চন্দ্র পাল

ড. তাপস চন্দ্র পাল অবসরপ্রাপ্ত একজন ক্ষুদ্র চাকরিজীবির মাসিক আয়ের একটি ব্যবস্থা না থাকলে তার জন্য সংসার চালানো কঠিন। বাজারে গেলে দেখা যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় মূল্যের দাম স্থিতিশীল থাকছে না, ফলে আমনতে সুদের হার এত কম হলে তা বাজারে মূল্য হারাচ্ছে। শৈশব, কৈশোর, কর্মজীবন ও বার্ধক্য যেন একই সূত্রে গাঁথা। জীবনের […]

এগুলো পড়তে পারেন