বড়গল্প: কোথাও নেই (প্রথম পর্ব)

follow-upnews
0 0

প্রথম পর্ব


টাকার স্তুপ শুধু ক্লান্তিই বাড়াচ্ছে এখন। এত কষ্ট করে এত টাকা কেন যে আয় করেছি! জীবনের প্রতি পদে পদে যার যা প্রাপ্য দিয়ে দিলে এত জমত না নিশ্চয়ই। কিন্তু কেউই তা দেয় না, আমিও দিইনি।

ব্যাংকের হিসেব দেখলে মাঝে মাঝে মনে হয়, এ যেন পাপ জমছে রোজ। তবু নেশা, এ নেশা ভয়ঙ্কর। প্রতিদিন দশ লক্ষ টাকা ব্যাংক একাউন্টে যোগ না হলে মাথা ঝিম ঝিম করে, মনে হয় কোম্পানির সকল কর্মচারীদের ডেকে বিদায় করে দিই আজই।

ছেলে-মেয়ে-জামাই সবাই বাপের কোম্পানির মালিক হয়ে বসেছে আরো দশবছর আগে থেকে। আমি বেঁচে আছি বলে কেউ শুধু এখনো প্রধান হতে পারেনি।

বেঁচে আরো কিছুদিন থাকব মনে হয়। কিছু পাপের প্রায়শ্চিত্য করব ভাবছি। মাঝে মাঝে মনে হত আগে, এখন সবসময় মনে হয়, মৃত্যুর পরে কিছুই নেই, কিন্তু পাপ মোচন করে না মরলে ভূত হয়ে থাকতে হবে আজীবন। ভূতের বিশ্বাসটা আমার যায় না কিছুতে। আমি ভূত হতে চাই না। পাপ মোচন করতে চাই।

পাপের হিসেব কেউ না জানলেও আমি তো সব জানি, রতনও অনেক জানে। দারোয়ানের বেতন মাসে এক লাখ টাকা শুনেছেন কেউ কোনোদিন? অফিশের সবাই জানে রতনের বেতন পনেরো হাজার টাকা, কিন্তু ওর চাহিদা মতো প্রতি মাসে লাখ টাকা পুরোয়ে দিই আমি।

না দিয়ে উপায় আছে কিছু? সেই কুট্টিকাল থেকে ও আমার সাথে আছে, জানে অনেক কিছু! ও শিক্ষিত শয়তান হলে ব্লাকমেইল করে এতদিন কোম্পানির একটা অংশই আমার কাছ থেকে বাগিয়ে নিত।

ইদানিং শুধু আমি পাপ মোচনের উপায় খুঁজছি। গত পঞ্চাশ বছর যে পাপ করেছি তা কি আগামী পাঁচ বছরে কাটাতে পারব আমি? পাঁচ বছর সময় কি আমার হাতে আছে?

গত পরশুদিন রাতে স্বপ্ন দেখলাম, পাপ করলে সাতদিনের মধ্যে কাটাতে হয়, না হলে কোনোভাবে আর তা মোচন হয় না! তাহলে আমার কী হবে? আমার পুরনো পাপ কি সব তাহলে রয়ে যাবে? এত টাকা পয়শা দিয়ে কিছুই তাহলে হবে না?

এক গুরুর কাছে গিয়েছিলাম কিছুদিন আগে। সে বলল, স্বামী-স্ত্রী একসাথে যেতে হবে। স্ত্রী তো দুইজন, ভাবছি কাকে নিয়ে যাই। দুজনকেই নিয়ে গেলাম। গুরুদেব স্ত্রীদের হাত দেখে বললেন, বড় স্ত্রীর কোনো ফাড়া নেই, ছোটজনের আছে।

আমি তার সাথে গোপন আলোচনায় বসলাম, উনি শুধু মাথায় হাত দিয়ে থাকেন, কিছুই বলেন না। জিজ্ঞেস করলাম, গুরুদেব, আপনি তো কিছুই বলেন না, বিষয়টা কী?

বললেন, কেমন করে বলি! আমি অভয় দিলে উনি বলতে শুরু করলেন, বললেন, ছোট স্ত্রী আমার জন্য অভিশাপ, ধীরে ধীরে আমার পতন হবে ওর জন্যে। এছাড়া ছোট স্ত্রীর নাকি পরপুরুষের সঙ্গ আছে।

আমি বললাম, গুরুদেব আমি তো পাপ মোচনের উপায় জানতে এসেছি, পাপের সন্ধান করতে তো আসিনি। গুরুদেব বললেন, এ তো তোমার পাপ নয়, স্ত্রীর পাপের কিংদংশ তোমার, তাই এখনই সতর্ক হলে মুক্তি পেতে পারো। বলুন, তাহলে কী করতে হবে?

না, আমি এখনই তোমায় ওকে ত্যাগ করতে বলব না। তুমি একটা কাজ করো, ওর জন্য আমি কিছু ওষুধ দিই, এটা মাস খানেক খাক, দেখ কাজ হয় কিনা। গুরুদেব এক ব্যাগ ওষুধ দিলেন। বুঝলাম, এরকম সমস্যা নিয়ে তার কাছে অনেকেই আসে, বেশ পরিপাটি ব্যাগে ওষুধগুলো গোছানো।

আমি দাম জিজ্ঞেস করতেই উনি রেগে গেলেন, বিড়বিড় করে উপরের দিকে তাকিয়ে কী যেন মন্ত্র পড়ে হোমের আগুন জ্বালালেন। ওনার শিষ্যরা আমাদের কিছুক্ষণের জন্য বাইরে পাঠিয়ে দিলেন।

আবার আমাদের ডাকলেন। ছোট স্ত্রীকে অনেকক্ষণ নিরীক্ষণ করে মাথায় জোরে জোরে তিনটে ফুঁ দিলেন। আমাকে বললেন, চোখ বন্ধ করে দুই স্ত্রীর মাঝখানে বসতে। এরপর মনে মনে ভাবতে বললেন, চোখ খুলে আমি কাকে দেখতে চাই।

অনুমান করে কমপক্ষে পাঁচ মিনিট পর আমাকে চোখ খুলতে বললেন। এখন প্রতি এক মিনিট পর পর পর্যায়ক্রমে ছোট স্ত্রী এবং বড় স্ত্রী উঠে যাবে, চোখ খুলে আমি যাকে দেখতে চেয়েছি তাকে দেখছি কিনা —এটাই হচ্ছে খেলা।

এভাবে কয়েক দিন গুরুদেবের কাছে গিয়েছি, কিন্তু আমার এতদিনের পাপ মোচনের জন্য কিছুই করতে পারিনি, বরং নতুন নতুন পাপ আবিষ্কৃত হচ্ছে। গুরুদেবকে জোরকরে পাঁচহাজার টাকা দিলাম, উনি টাকা নিতে চান না কিছুতে!

ক্লান্ত-বিরক্ত হয়ে অন্য কিছুতে মন দিতে ইচ্ছে করলাম। ইদানিং ফেসবুকে দেখি বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যায়। আমিও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে গিয়েছি ব্যবসার প্রয়োজনে, নিয়মমাফিক কাজ সেরে চলে এসেছি।

ভালো থেকেছি, ভালো খেয়েছি, কিন্তু ওরা যেভাবে বলে ওরকম কিছু দেখিনি কোথাও কোনোদিন। হতে পারে সেরকম কোথাও আমি যাইনি হয়ত!

দেশ-বিদেশের এরকম সব জায়গায় ঘুরব ভাবলাম, একাই যাব। ধ্যানী-জ্ঞানী হতে গেলে নাকি একাই থাকতে হয়। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন মনে পড়ে গেল হঠাৎ—

বহুদিন ধরে’ বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্ব্বতমালা
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু।।

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ভাবলাম, দূরে কোথাও তাহলে যাব না, গ্রামে যাব। খুব সাধারণভাবে ঢাকার পাশ্ববর্তী নবাবগঞ্জের একটি গ্রামে গেলাম। ওখানে নাকি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আছে, আবার রাজাদের পোড়ো বাড়িগুলোও দেখা যায়।

সামান্য কিছু পোশাক পরিচ্ছদ একটি সাধারণ ব্যাগে নিয়ে ব্যক্তিগত গাড়ি পরিহার করে গেলাম কলাকোপা নামক জায়গায়।

ইছামতির পাড়ে বসে থেকে রবীন্দ্রনাথের কবিতার সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা করলাম, জমিদারদের পোড়ো বাড়িগুলো দেখলাম। কিছুই সুখ হল না! ওগুলো আমার ভেতরের হাহাকার আরো বাড়িয়ে দিল বরং।

আবার ইছামতির পাড়ে গিয়ে বসলাম, অনেকক্ষণ বসে থাকলাম, জীবনের অধ্যায়গুলো উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখলাম। অর্থ-বিত্ত ছাড়া কিছুই দেখতে পাই না জীবনে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, একটি থাকার জায়গা তো লাগবে। খুব ভালো খুঁজছি না, ফকির দরবেশদের মতো সাধারণ হতে চাচ্ছি। সাধারণ মানুষ নাকি সুখী, আমিও সুখী হতে চাই।

একটা রেস্ট হাউস মতো পেয়ে ওখানেই রাত কাটাতে মনস্থির করলাম। যা খাবার ওখানে! রাতে ঠিকমত খেতে পারলাম না, ঘুমোতেও পারলাম না তেমন।

সকাল সকাল আবার বেরিয়ে পড়লাম, সকাল বেলায় হাঁটতে ভালোই লাগছে। শূন্য গ্রাম্য রাস্তা, মাঝে মাঝে দু’একটা বাড়ি, হঠাৎ আমার শৈশবের কথা মনে পড়ল।

ছোটবেলায় যে গ্রামটিতে আমরা থাকতাম— রামগঞ্জের ঘরিয়া নামক একটি গ্রাম, অনেকদিন গ্রামে যাইনি, সেই যে বারো বছর বয়সে বাবার সাথে গ্রাম ছেড়ে এসেছি আর কখনো যাওয়া হয়নি।

তখন যে গ্রামে কত কী আয়োজন ছিল! এখন আর গ্রামেও কোনো নির্ভেজাল আয়োজন নেই, খেলাধুলা নেই, গল্প-আড্ডাও আর হয় না।

এখানে কালকে সন্ধ্যেয় দেখলাম— কিছু মানুষ টিভি দেখছে, যুবকরা একসাথে বসে আছে যে যার মতো মোবাইল হাতে নিয়ে। একটু দূরে দরিদ্র শ্রেণির কয়েকটি বাচ্চা ছেলেকে দেখলাম নদীতে ডুবোডুবি করতে।

মৈনটঘাট নামে একটি জায়গার নাম শুনেছি ঢাকায় থাকতে। ওখানে ছেলেপেলে আজকাল খুব যায় দেখি। অনেকে মারাও গিয়েছে পদ্মা নদীতে সাঁতার দিতে গিয়ে। ওখানেই তাহলে যাই। একটা অটোরিক্সা নিয়ে চলে আসলাম।

সকালের সোনা রোদ নদীতে পড়ে চিকচিক করছে, এত সকালে এখানে কেউ ঘুরতে আসেনি— দুএকজন গেরস্থ এসেছে গরু বাঁধতে, দুএকটি জেলে নৌকা দেখতে পাচ্ছি।

দেখে বোঝা যায়— এটা একটি নির্জন নিরিবিলি স্থান ছিল, মানুষ এসে এসে জায়গাটিকে সরগরম করেছে, দুএকটি দোকান হয়েছে, যদিও সেগুলো এখনো খোলেনি।

নদীর ধারে অনেকক্ষণ ধরে হাঁটছি, বেশ ক্লান্ত লাগছে। এখানে আশেপাশে খাওয়ার কোনো জায়গা আছে মনে হচ্ছে না।

না, “চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া” কিছুই আমি দেখতে পাচ্ছিনে, সময়টা বর্ষাকাল ছুইছুই করছে, এখন ধানের শীষের উপর শিশিরবিন্দু দেখা সম্ভব নয়। কবি কি তাহলে শুধু শীতকালের কথা বলেছেন!

এখানে আর থেকে লাভ নেই। মাওয়া ঘাটে যাই, ওখানে তাজা ইলিশের ডিম দিয়ে এক প্লেট ভাত খাব, এরপর চিন্তা করব কোথায় যাওয়া যায়। যতক্ষণ না সাধারণ মানুষের মতো সুখ খুঁজে পাই ততক্ষণ আমি ঘুরতেই থাকব। -চলবে


বড় গল্প: কোথাও নেই (দ্বিতীয় পর্ব)

দিব্যেন্দু দ্বীপ

Next Post

গণহত্যা-১৯৭১: প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য

সিরাজদিখানের রসুইন গ্রামে রামকৃষ্ণ সিংহের বাড়িতে ১৯৭১ সালে সংগঠিত গণহত্যার ভুক্তভোগী এবং প্রত্যক্ষদর্শী সুনীল ঘোষ পিন্টু পিতা: শহীদ জীবন ঘোষ ঠিকানা: ২৪ ফরাশগঞ্জ লেন, সূত্রাপুর, ঢাকা-১১০০। জীবন ঘোষের পরিবার মালাকারটোল হত্যাকাণ্ড সংগঠনের দিন এলাকা ছেড়ে নদীর ওপার বিক্রমপুরের দিকে চলে যান। রসুইন গ্রামের যে বাড়িতে জীবন ঘোষের পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল […]
Sunil Ghosh Pintu