বড় গল্প: কোথাও নেই (চতুর্থ পর্ব)

follow-upnews
0 0

অনভ্যস্ততার কারণে বসতে একটু অসুবিধা হচ্ছে, আবার ভালোও লাগছে —এভাবে চালকের পাশে বসে সবকিছু দেখতে দেখতে শেষ যে কোথাও কবে গিয়েছিলাম মনে নেই। পাশ দিয়ে লোকজন উঠছে নামছে, সবাইকে খুব উদ্বিগ্ন মনে হয়, আচ্ছা আমাদের দেশের বেশিরভাগ মানুষ কি সবসময় উদ্বিগ্ন থাকে?

গোপালগঞ্জ শহর হতে বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরে ঘোনাপাড়া নামক স্থানে নেমেছি। রাত আটটা বাজে প্রায়, এখন কী করা যায় ভাবছি— সম্পদশালী হলে ভিখিরি সাজা অনেক সহজ, তাই কোনো ধরনের অনিশ্চয়তার ভয় আমার নেই। তাৎক্ষণিক কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ব্যতীত এমনি কোনো বিপদে পড়ব না, টাকার জোরে উতরে যাব জানি। 

চায়ের একটা টং দোকানে ঢুকলাম, স্বাভাবিক সময়ে হলে এভাবে এক কাপ চা খাওয়ার কথা আমার স্টাটাসে থেকে মানতে পারতাম না, সিদ্ধান্ত নিয়ে এখন সবই করতে পারছি। খুব বেশি জায়গা না থাকলেও আমার এক হাত দূরে বসল একজন রিক্সালা, সম্ভবত আমার পোশাকে কোনো আভিজাত্যের ছাপ আছে, এজন্য লোকটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছে— এতে আমি সম্মানিত বোধ করলাম না, বরং অপমানবোধই করলাম। আবার এটাও সত্য যে, গা ঘেষে বসলে ঘামের তাজা গন্ধে বিরক্তও লাগত। চায়ে চিনি খাওয়া বন্ধ করেছি আরো দশ বছর আগে, সেদিকে আর গেলাম না— দুধ চিনি যা দিছে খেয়ে নিলাম।

চা খাওয়াটা এই মুহূর্তে আমার কাছে গৌন হয়ে গিয়েছে, বরং দেখছি পাশের লোকটির হাবভাব। পায়ের উপর পা তুলে যেভাবে এক কাপ চা সে একটি সিগারেট সহযোগে খাচ্ছে— তাতে এটা বুঝতে পারছি যে, সারাদিনের ক্লান্তি শেষে এটুকু তার একান্ত নিজস্ব পরিমণ্ডলে কিছুটা দাম্ভিক হওয়ার চেষ্টা, এ শুধু চা খাওয়া নয়। এ দোকানটিতে প্রধানত রিক্সালারাই কাস্টমার, তাই আমার মতো একজন অপরিচিত ভদ্রলোকের চেয়ে ওদেরই খাতির যত্ন বেশি। চট করে মাথায় আসলো— যেরকম পোশাক পরে আছি এটা একটি সমস্যা, পোশাক পরিচ্ছদ আরো সাধারণ করতে হবে।

আজকে আর টুঙ্গিপাড়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাদ দিলাম, গোপালগঞ্জ শহরে এসে কোনো একটা হোটেলে থাকার কথা ভাবছি। দশ বারো বছর আগে গোপালগঞ্জ এসেছিলাম ব্যবসার কাজে— ‘ব্যাংকপাড়া’ নামটার কথা মনে পড়ছে, রিক্সালাকে ওটাই বললাম। ব্যাটারি চালিত এই রিক্সাগুলো এমন বিপদজনক তাতো জানতাম না! যতই বলি আস্তে চালাতে, ও জোর বাড়াতেই থাকে, মনে হয় এই বুঝি উলটে পড়লাম। বয়স ষাট ছুইছুই, ভয় পাওয়ারই বয়স— চলতে ভয়, ফিরতে ভয়, খেতে ভয়, শুধু ভয় আর ভয়, বাইরে একটা সাহসের এপ্রন চাপিয়ে বাঁচতে হয়। ব্যাংকপাড়া রাস্তার মুখে নামলাম, জায়গাটা নির্জন, পাশে একটা গ্যারেজ, তার পাশে ছোট্ট একটা দোকান— টেবিলের উপর দুটো ফ্লাক্স দেখে বুঝলাম চা পাওয়া যেতে পারে।

এতক্ষণ শুধু দোকানটাই দেখতে পাচ্ছিলাম, হঠাৎ দোকানদারকে দেখে বেশ একটু চমকে গেলাম— ত্রিশ পয়ত্রিশ বছর বয়সী বেশ পরিপাটি একজন দোকানদার, পরিপাটি হলেও দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। এত রাতে এমন একজন নারী দোকানদার আমাদের দেশে খুব বিরল। হঠাৎ একটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করল, এক কাপ চিনি ছাড়া লাল চা নিয়ে সিগারেট ধরিয়ে সামনে রাখা বেঞ্চের উপর বসলাম। আমি দোকানদার নারীর দিকে তাকাচ্ছি না, কিন্তু সে যে আমাকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে সেটি অন্যদিকে তাকিয়েও বুঝতে পারছি। নারীরা দেখতে পছন্দ করে, এবং অতটুকুই, পুরুষ ভাবে অন্যকিছু, আমিও একজন তথাকতিথ পুরুষই, কিন্তু আমার ভেতরে কিছু যেন একটা রয়েছে —বুঝতে পারি আবার পারিও না। 

দোকানদার নারী টাকা খুচরো করতে পারছে না, আবার পাশে কোনো দোকানও নেই। যদিও আমার কাছে খুচরো টাকা আছে— বললাম, থাক পরে কখনো ফেরৎ দিয়ে দেবেন। আমি কোথায় থাকি উনি জানতে চাইলেন, বললাম, পাশেই থাকি। নিজেই বললেন, “ওহ! নতুন এসেছেন।” মনে করেছেন আমি চাকরির পোস্টিং নিয়ে এ জেলায় নতুন এসেছি। কথা আর বাড়ালাম না।

কিছুদূর এসে মনে পড়ল, সাথে থাকা ছোট্ট ব্যাগটি ফেলে এসেছি। ফিরে গেলাম— খুব বিনয়ের সাথে দোকানদার নারী ব্যাগটি ফিরিয়ে দিল। ব্যাগ খুলে জিনিসপত্র চেক করার প্রয়োজন বোধ করলাম না, দীর্ঘ ব্যবসায়ীক জীবনে এ অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে, বুঝতে পারি কে চোর আর কে বাটপাড়। আমার মতো একজন বয়সী টাকাওয়ালা পুরুষের নারীটির প্রতি কিছুটা আকর্ষণ অনুভব করা এই নির্জন পরিবেশে একেবারে অবান্তর নয়, তবে আমি তো সিদ্ধান্ত নিয়েই বেরিয়েছি যে, আমি এ কয়দিন শুধুই একজন পরিব্রাজক, তবুও নারীটির সম্পর্কে জানতে চাইলাম। গড়গড় করে বলে গেল সে সব— স্বামীর অকাল মৃত্যু, ছেলে মেয়ে নিয়ে তার সংগ্রাম সবকিছু। অন্য সময় হলে তার প্রতি আগ্রহী হয়ে তার জন্য কিছু করার চেষ্টা করতাম, কিন্তু বর্তমান সময়ে কোনো দিক থেকেই আর বাস্তবতার ঘেরাটোপে পড়তে চাই না। ফলে তার কথা শুধু শুনেই গেলাম, কোনো ভাবান্তর দেখালাম না। যদিও মনে রেখে দিলাম পথিক হয়ে বিশেষ এই পথিকের কথা।

গোপালগঞ্জ শহরে অনেক পরিচিত মানুষ আছে— যদিও দেশের মানুষের কাছে আমি তেমন পরিচিত কেউ নই, কিন্তু অনেক দোকানদার আমাকে চেনে কোম্পানির কারণে, সামনে পড়ে গেলে কী যে বলব! একটা রিক্সা ডেকে একটা আবাসিক হোটেলের সামনে নিয়ে যেতে বললাম, ভালো মন্দ নিয়ে ভাবছি না, রাতটা কাটাতে চাই। তার আগে কিছু খাওয়া দরকার। খুব সাদামাটা কিছু খেতে চাই। খাওয়ার ব্যাপারা আজীবনই আমি উদাসিন থেকে গেলাম, আজও তার ব্যতিক্রম নয়, রিক্সালাকে জিজ্ঞেস করলাম কোথাও ভালো আটার রুটি পাওয়া যাবে কিনা। নিয়ে গেল কাঁচা বাজারের মধ্যে একটা দোকানে।

‘খাওয়ার ব্যাপারে উদাসীন’ বলেছি বলে আবার ভাববেন না যে, এতদিন আমি সাধু বৈষ্ণবদের মতো জীবন কাটিয়েছি। নাহ! তা মোটেও না, তরমুজ খেতে দিলে আমাকে উপরের এক ইঞ্চিই দেয়, বুঝতে পারছেন তো— মানে ঠিক মাঝখানের চিকন লাল অংশটা। আমার ছেলে মেয়েরাও তাই-ই করে, বেদানার শুধু রসটুকু বের করে নেওয়া হয় মেশিনে চিপড়ে। ভোগবিলাসিতার চূড়ান্ত চর্চা চলে বাসায়, যদিও অফিশে কৃচ্ছতা সাধনের দোহাই দিতে হয়, কর্মচারীদের দেখাতে হয়— অফিশের সবাই জানে স্যার খুব মিতব্যয়ী, একটা ভাতের দানারও অপচয় করে না। এগুলো অনাচার, অবসরে চোখ বুঝলে বুঝতে পারি সব। কিন্তু এই চর্চা ভয়ঙ্কর, একবার আপনি ভোগ বিলাসিতার চক্রের মধ্যে ঢুকলে আর বের হতে পারবেন না, আপনি বের হতে পারলেও দেখবেন আপনার ওপর ভর করেছে আপনার দারা পুত্র পরিবার! 

এতটা নোংড়া পরিবেশে অনেকদিন অভ্যস্ত নই, সেটি এ মুহূর্তে ভাবতে চাই না, কাউকে বুঝতেও দিতে চাই না। বড় একটা রুটি, একটা হাঁসের ডিম মামলেট, আর এক পোটলা পেঁপের তরকারী কিনে নিলাম। বিস্ময়কর ব্যাপার— বিল আসলো মাত্র পয়ত্রিশ টাকা। পয়ত্রিশ টাকায় বাইরে বেরিয়ে আমার রাতের খাবার শেষ! আমার জন্য এ এক নতুন জীবন, কতটা উপভোগ করছি বলে বুঝাতে পারব না। ফেরার সময় এই দোকানটির গল্প বলছে গর্বিত হয়ে রিক্সালা আমায়— দোকানটি তিন বংশ ধরে এখানে চলছে, শুধু রুটিই বিক্রি করে, তা দিয়েই তিন ভাইয়ের তিনটি পরিবার চলে। কিছু জিনিসের কদর বোধহয় সারাজীবনই থেকে যাবে, ভাত রুটি তেল নুন তেমনই তো পণ্য –এসব ব্যবসার সাথে যারা জড়িত তাদের প্রতি আমার বিশেষ শ্রদ্ধা রয়েছে।

মানবসেবা ব্যবসা দুটোই হয় মানুষের বাঁচার উপকরণ নিয়ে ঠিকমতো কারবার করতে পারলে। মাত্র পঁয়ত্রিশ টাকায় রুটি ডিম সবজি পেয়ে আমি খুব সুখী এই মুহূর্তে, যদিও আমি টাকার কারণে খুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই, আমি খুশি হচ্ছি চাহিদা মতো টাটকা খাবার পেয়ে। আবার বিক্রেতারাও এই পঁয়ত্রিশ টাকার মধ্য দিয়ে তাদের প্রয়োজনীয় লাভটুকু করে নিয়েছে। সঠিক এবং নির্ভেজাল পণ্যের জন্য পৃথিবীতে স্থানীয় ব্যবসা বেশি জরুরী, কিন্তু এটা বহুজাতিক কোম্পানির যুগ, এদিক থেকে পৃথিবী যে ভুল পথে আছে এবং যাচ্ছে সেটি আমার এই ছোট্ট মাথা দিয়েও বুঝতে পারি। আবার এটাও সত্য ব্যবসা বাণিজ্যের সকল পদ্ধতি স্থানীয় হলে প্রযুক্তির প্রসার এভাবে পৃথিবীতে হত না, ফলে খুব সহজ কোনো সমাধান এক্ষেত্রে নেই। তবে বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে যে, ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে স্থানীয় নির্ভরতা উত্তম। এখনো আমাদের দেশের সাধারণ লোকের ধারণা ব্যবসা মানে লোক ঠকানো, ব্যবসা মানে ধান্দাবাজি— আসলে কিন্তু তা নয়, ব্যবসা মানে নতুন নতুন উদ্যোগ —এসব উদ্যোগের কারণেই পণ্যের যোগান নিশ্চিত হয়, অর্থনীতির চাকা সচল হয়।

থাক, ভাবনাগুলো আবার বাস্তবতার রং পাচ্ছে, এখনই আরেক কাপ চা খাওয়া দরকার। রিক্সালাকে চা খাওয়ার কথা বলতেই নিয়ে গেল গোপালগঞ্জ শহরের বটতলার মোড়ে। মোড়টা সুন্দর, একটা বটাগাছ, বটগাছের নিচে বাঁধিয়ে রাধা কৃষ্ণ রাখা হয়েছে —এটা ব্যতিক্রম, সাধারণত বট গাছ লাল কাপড় দিয়ে ঘিরে এদেশে মাজার বানানো হয়। সম্ভবত জায়গাটি হিন্দু অধ্যুষিত— চা খেতে খেতে খোঁজ নিয়ে তাই-ই জানলাম, এমনিতে এটা জানি যে, স্বাধীনতার পরেও অনেক বছর গোপালগঞ্জ জেলায় হিন্দু জনসংখ্যা বেশি ছিল, এই জেলাটাই চৌষট্টি জেলার মধ্যে একমাত্র জেলা যেখানে হিন্দুরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ —যদিও এই ভাবনাগুলো প্রাচীন এবং অপ্রয়োজনীয়, কিন্তু এসব তো এখনো আছে, মানুষ ধর্মের নামে মারছে মরছে, মসজিদ হবে না মন্দির হবে তা নিয়ে ঠেলাঠেলি করছে কখনো ভীষণ অসভ্য হয়ে, কখনো সভ্যতার বেশে নীরবে।

আমিও একটি সাম্প্রদায়িক পরিমণ্ডলের মধ্যে থাকি বেশিরভাগ সময়— দান ধ্যান করতে হয়, পূজোয় মোটা অংকের চাঁদা দিই, গীতা বিতরণ করি, আরো কত কী যে করি! লোকজন আসে, তোষামোধ করে, মন্দিরের সভাপতি বানায়, উপদেষ্টা বানায় —নিজেরে ভুলে যেতে হয়। শুধু কী তাই? এইতো গত শীতকালে একটি ওয়াজ মাহফিলে এক লক্ষ টাকা দিলাম, দশ বারোজন মাওলানা এসে দরবার করে নিয়ে গেল, আসলে আমিই কৌশলে তাদের অফিশে এনে টাকাটা দিয়েছি —এসব করতে হয়, ব্যবসা টিকিয়ে রাখা এবং ব্যবসার প্রসারের জন্যই করতে হয়। মানুষ বঞ্চিত হয়, একইসাথে মন্দির মসজিদ বা এসব মাহফিল ঘিরে গড়ে উঠেছে এমনই একদল বেশধারী মানুষ যাদের পেশা হয়ে উঠেছে আমাদের মতো ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে জীবন চালানো— এদের মধ্যে কেউ সংসারী, কেউ কেউ আবার শুধুই প্রতারক।

কেন যে এসব মাথায় আসছে? এভাবে কিন্তু কখনো ভাবিনি, ব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার শুধু করে গিয়েছি, আয় ব্যয়, ভোগ বিলাসিতা আর মাতব্বরি এই ছিল আমার জীবন। বুঝতে পারছি— এ কয়েকদিনে আমার মধ্য থেকে সুপ্ত কোনো সত্তা জেগে উঠেছে। প্রশ্রয় দিতে চাই, দেখি আমাকে কোথায় টেনে নিয়ে যায় অন্য এক আমি।


চলবে 

Next Post

অভিশঙ্কা // শাহিদা সুলতানা

নস্টালজিক সময়ের ছবি ছায়া হয়ে সাথে সাথে ঘোরে বাসে, ট্রামে, মেট্রোর পেটে খোলা মাঠে, স্টেডিয়ামে, যেখানে আলো পায় সেখানেই দীর্ঘ কালো রেখা একে হয় পথ আগলায়, নয় পিছু পিছু হাটে। আমি বসি, সেও জিরিয়ে নেয়, আমি উঠি, সেও আড়ামোড়া ভাংগে, আমি হাটি, সেও শুরু করে পথ চলা অবিরাম, অবিশ্রান্ত, নিরলস, […]
Shahida Sultana