মানুষ মানুষের সাথে বাস করে, পশু-পাখি, অন্যান্য প্রাণী প্রকৃতির সাথেও বাস করে, কিন্তু আমরা শুধু সতর্ক থাকি মানুষের সাথে বসবাসের ক্ষেত্রে, কারণ, মানুষই শুধু জবাব দেয়, প্রতিশোধ নেয়, যদিও প্রকৃতিরও পরোক্ষ জবাব আছে, প্রতিশোধ আছে।
কাঁদালে সবাই কাঁদে, তাই জীবনে চলার পথে প্রধান মন্ত্র হওয়া উচিৎ– কাউকে কষ্ট দেয়া যাবে না। এই একটিমাত্র দর্শন মানুষকে মানুষ করতে পারে। কাউকে কষ্ট না দেয়ার বিপরীতেই আছে সবাইকে ভালোবাসা। খুব বেশি ভালোবাসা কি লাগে? শুধু মাড়িয়ে না গেলেই হয়, কাঁদিয়ে না ফিরলেই হয়।
সরাসরি ‘না’ বলবেন না
১. পশ্চিমাদের মত সরাসরি ‘না’ করতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠছি দিন দিন, কিন্তু সেটি আমাদের সংস্কৃতি নয়, বাউল দর্শন, বাঙ্গালীর আবহমান সংস্কৃতির সাথে এভাবে ‘না’ বলাটা বেমানান। ধরুণ, কেউ এক হাজার টাকা ধার চাইল, টাকা না থাকলে তো তাকে দেওয়া সম্ভব নয়, তাই বলে সরাসরি তাকে ‘না’ বলার চেয়ে সামান্য কিছু সময় নষ্ট করে তার প্রয়োজনের মাত্রাটা বোঝার চেষ্টা করাটাই আমাদের আবহমানকালের দর্শন।
পশ্চিমাদের সরাসরি ‘না’ বলার সংস্কৃতির চেয়ে এটাই মানবিক এবং ঔচিত্য। তাই বলে কাউকে কথা দিয়ে কথা না রাখতে পারলে সমস্যার সৃষ্টি হয়, তাই কথা দেওয়া যাবে না নিশ্চিত না হয়ে। গাঁ বাচানোর জন্য ‘চেষ্টা করছি’ বলা যাবে না, নিজের সামার্থ অনুযায়ী প্রকৃত কথাটাই বলতে হবে।
অন্যকে জায়গা দিতে হবে
২. ইংরেজিতে এটাকে বলে ‘স্পেস দেওয়া’। খুব ছোট্ট দুটি শব্দ কিন্তু এর গভীরতা অনেক বেশি। প্রতিদিনের কিছু ছোট ছোট বিষয় খেয়াল করুন– বাসে উঠলে ধাক্কাধাক্কি লাগে, সেখানেও একে অপরকে জায়গা দেয়ার প্রশ্ন আছে না? মাঝে মাঝে তুমুল ঝগড়াও লেগে যায় না? অনেক সময় দেখবেন সিটে লোকটি এমনভাবে বসে আছে যে পাশের সিটে বসা যায় না, অর্থাৎ আরেক জনকে জায়গা দেওয়ার মানসিকতা তার নেই।
একটু কম প্রশস্ত সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় আরেকজন বিপরীত দিকে থেকে উঠে আসতে থাকলে দু’জনই না কাত হলে ধাক্কা লাগবে, অনেক সময় দেখবেন আপনার সামনের লোকটি ‘ডোন্ট কেয়ার’ –এটা হচ্ছে জায়গা না দেওয়ার মানসিকতা, ঔদ্ধত্য।
এগুলো বস্তুগত উদাহরণ। কিন্তু এর চেয়েও বড় ব্যাপার হচ্ছে– মানসিকভাবে অন্যকে জায়গা দেওয়া, অবশ্য দৈনন্দিন চর্চাগুলো আপনার-আমার মানসিকতারই প্রতিফলন। প্রতিদিন আমরা কেমন মানুষ সেটির যোগফলই দিনশেষে আমি এবং আপনি।
কাউকে আক্রমণ করে কথা বলা যাবে না
৩. এটা আমরা যে শুধু ঝগড়ার সময় করি তা নয়, কেউ কেউ এটা সবসময় করে, খোঁচা দিয়ে কথা বলা, অন্যকে ছোট করে কথা বলার অভ্যেস অনেকেরই আছে। এটা খুবই মন্দ। অনেক বেশি সতর্ক হতে হয়।
যেমন, আপনি বললেন– “বন্ধু, তুই তো অনেক ভালো মানুষকে ম্যানেজ করতে পারিস, আমি পারি না, তুই একটু দেখ না ….।” কথাটা কি সুন্দর কথা হল? আপনি কাউকে ‘অনুরোধ’ করার জন্য বা কোনো কাজের জন্য বন্ধুর সাহায্য নিতেই পারেন, কিন্তু “সে মানুষকে ভালো ম্যানজে করতে পারে, আপনি পারেন না” এটা বলে আপনি কী বুঝাতে চাইলেন? হয়ত আপনি বুজে বলেননি, কিন্তু কথাটার মানে দাঁড়াল– আপনি যতটা ভদ্রলোক, আপনার বন্ধু অতটা নয়। তাই নয় কি? দেখলেন তো কতটা সুক্ষ্ম কথার মধ্যেও কতটা স্থুল বিষয় থাকতে পারে! তাই সাবধানতা অবলম্বন করাটা জরুরী।
কোনো সম্পর্ক চিরতরে শেষ করে দেওয়া যাবে না
৪. মানুষ বদলায়, ভালো থেকে মন্দ হয়, আবার মন্দ থেকে ভালোও হয়, তাই মানুষকে সময় দিন, সুযোগ দিন। কারো সাথে যুদ্ধ আপনার বাধতেই পারে, কিন্তু সেটি সাামজিকভাবে, আইনগতভাবে করুন, এমন কিছু বলার দরকার নেই যাতে সম্পর্কটা চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে যায় বা সে চিরশত্রু হয়ে যায়।
মানুষ সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায় কথায়, আবার তার ভালোও লাগে আপনার কথায়। আইন আদালতের প্রয়োজন হয় এমন সমস্যা কি জীবনে খুব বেশি মানুষের সাথে খুব বেশি সৃষ্টি হয়? কিন্তু এমন হয়ত হয় যে, হরহামেশাই আপনি মানুষের সাথে গণ্ডগোল পাকাচ্ছেন মানুষকে অপমানজনক কথা বলে বলে। এটা না করলে সামাজিকভাবে আপনি অনেক লাভবান হবেন।
কৌশলী হতে হবে
৫. এটা সত্য যে কিছু ভয়ঙ্কর রকমের মন্দ মানুষ সমাজে আছে, তাদেরকে মোকাবেলা করা প্রয়োজন, তাদেরকে ঠেকিয়ে রাখতে পারলে ভালো। এই মানুষগুলো সমাজে বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে খুব ভয়ের কথা। তাই বলে দিগ্বিদিক হারিয়ে তাদেরকে মোকাবেলা করতে যাওয়া যাবে না।
এরা সবই করতে পারে, অনেক নিচে নামতে পারে, কিন্তু আপনি পারবেন না, তাই কৌশলে এগোতে হবে। এমন একটি কাঠামো আগে প্রস্তুত করতে হবে যেটি দিয়ে তাদেরকে ঘায়েল করা যায়। মনস্তাত্ত্বিকভাবে তাদেরকে আগে পরাজিত করতে হবে। নিজের পরিচ্ছন্ন ইমেজ আগে তৈরি করে নিতে হবে।
জীবন সুন্দর, তবে সুন্দরভাবে জীবন-যাপন করা খুব সহজ নয়, এটা শিক্ষা-রুচি-চর্চা এবং অভিজ্ঞতার বিষয়।
#লেখক: দিব্যেন্দু দ্বীপ