আজিম উদ্দিন খুব বিবেচক লোক, বেশ রাশভারীও। এলাকায় তাঁর নামডাক আছে, শুধু টাকা পয়শা আছে বলে নয়, আজিম উদ্দিনের কিছু বৈশিষ্ট আছে—গ্রামের অশিক্ষিত দরিদ্র সাধারণ লোকগুলো ওটাকেই সঠিক বলে ধারণ করে ফেলেছে।
আজিমও অশিক্ষিত, কিন্তু টাকাপয়শা এবং ধার্মিকতায় তাঁর অশিক্ষা ঢাকা পড়ে গেছে।
খুব গরম পড়েছে এবার। পারতপক্ষে এ সময়টা সে বাইরে বের হয় না। কিন্তু আজকে যেতে হয়েছিল, একটা দাওয়াত ছিল মুন্সি পাড়ায়।
খেয়েদেয়ে আর দেরি করে নাই। খুব খায়ও নাই। সতর্ক জীবনযাপনে বিশ্বাসী সে, নামাজ কাজা করে না, নিয়ম মেনে ডাক্তারের কাছে যায়, ডাক্তারের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে।
প্রায় সত্তর বছর বয়স তাঁর, কিন্তু দেখে বুঝবার উপায় নেই। গত বিশ বছর ধরে গ্রামের মানুষ তাকে এমনই দেখে আসতেছে। ত্রিশ বছর ধরে সেইই গ্রামের প্রধান মুরব্বি—এ বিষয়ে কারো কোনো রা নেই।
বলতে গেলে গ্রামের অর্ধেক সম্পদ তাঁর, বাজারে পনেরো বিশটা দোকান রয়েছে। বাড়িতে বিশাল মাছের ঘের, পুকুর, জেলা সদরে জায়গা, আরো বিভিন্ন রকম সম্পদ আছে। ছেলেমেয়েরা সবাই প্রতিষ্ঠিত।
তবে সে রাজনীতিতে জড়ায় না, রাজনীতির লোকের তাঁর বাড়িতে দিনের বেলায় কখনো আসেও না।
কিছুদূর আসতেই একটা জটলা দেখে আজিম সাহেব দাঁড়ায়। একটা ছেলে ডাব পাড়তে গাছ উঠতে গিয়ে ছেঁচড়ায়ে পড়ে গেছে, বুকপেঠ খুব ছিঁলে গেছে । ব্যথায় কাঁতরাচ্ছে।
বয়স্ক এক মহিলা আজিম সাহেবকে সালাম দিয়ে বলল, “মুরুব্বী, ওরে একটু হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা লাগে যে।”
আজিম কড়া স্বরে বলে, “হাসপাতালে পাঠাইবেন কেনো, আগে দুই ঘা বসায়ে দেন—এই দুপুরবেলা ডাব খাইতে হইল কেনো ওর—এইডা একটু শুইনা হেরপর যশুর লতা ছেইচ্ছা মাইখা দেন বুকপেটে।” এই কথা বলে দ্রুত পায়ে সে হেঁটে যায়।
কিছুদিন যেতেই দেখে কিশোর বয়সী আরেকটি ছেলে গাছে ওঠার চেষ্টা করতেছে। পাশে দুইতিনজন লোক দাঁড়ায়ে আছে।
ছেলেটি রোগাপটকা। সিরাজুম নামে গ্রামে ঘুরান্তি এক মহিলা আছে। তাকে সবাই ‘ঘুরান্তি’ বলে ডাকে, কারণ, তাঁর কোনো বাড়িঘর নেই, কাজ করে আর যেখানে সেখানে থাকে। ছেলেটাও ওরকম মায়ের সাথে—এখন একা ঘুরে বেড়ায়।
আজিম খুব চেঁচায়ে বলে, “ভাত খাইতে পারস না, ডাব খাইতে হইব তোগো ভরদুপুরে অহন। ঐধারে একটায় বুকপিঠ ছাইলা ব্যথায় কোঁয়াচ্ছে দেইখে আসলাম।”
গাছের মালিক জব্বার দোকানদার, সর্বসাকুল্যে দুইটা নারিকেল গাছ তাঁর—জব্বার একটু আমুদে মানুষ, অভাব থাকলেও গায় মাখে না, লোকজন সাথে নিয়ে আমোদফূর্তি করতে পছন্দ করে।
জব্বাররে নজরে এনে আজিম বলে, “কীরে জব্বার, মসজিদে টেকাপয়শা তো কিছু দিলি না!” জব্বার মাথা নিচু করে লজ্জিত হয়।
ছেলেটি দক্ষতার সাথে সবুজ এক ছড়া ডাব নামিয়েছে দড়ি বেঁধে। মোট সাতটা ডাব আছে ছড়ায়। ওকে ধরলে লোক আছে ওখানে ছয় জন।
আজিম দরদী হয়, পকেট থেকে দশ টাকা বের করে ছেলেটিকে দিয়ে বলে, “যাও বাবা, ঘাইমে গেছো খুউব, দৌঁড়ে পুস্কনিতে গিয়ে ঝাঁপায়ে পড়ো।”
রাব্বান ফ্যালফ্যাল করে কয়েকবার তাকায়ে ‘টাকা লাগব না’ বলে দৌঁড় দেয়। জব্বার দোকানদার সবচে ভালো ডাবটি সুন্দর করে কেটে দোকান থেকে একটা গ্লাস এনে আজিম সাহেবকে দেয়।
আজিম উদ্দিন তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। বলে, “জব্বার, তোর ডাবের পাইনি খুউব মিঠারে!”
জব্বার আরেকটা ডাব কেটে তাঁর ছেলের হাতে দিয়ে বলে, “যা এইডা তোর নানিরে দিয়ে আয়।” রুবেল ডাব হাতে আজিম উদ্দিনের পিছু নেয়।
গল্পটি দিব্যেন্দু দ্বীপ এর গল্প সংকলন থেকে সংগৃহীত।