দুটো মৃত্যু—একটা খুন করেছে খুনী, খুনীকে খুন করেছে রাষ্ট্র, অার এই দুজনকেই খুন করেছে সমাজ, যেহেতু সমাজ হচ্ছে ধারক-বাহক-পোষক।
সমাজ খুনী হয়ে উঠলেও সমাজকে খুন করা যায় না, সমাজের বিচার করে শাস্তি দেওয়া যায় না। বহু জীবন ধারণ করে সমাজ হয়ে যায় জড়ো, তাকে কীভাবে শাস্তি দেওয়া সম্ভব? জড়োর তো কোন শাস্তি হতে পারে না, কিন্তু জড়ই সর্বাধিক শক্তিশালী সত্তা, মাটি-পানি-বায়ু এরা সবাই জড়, আবার এসব উপাদানই জীবনের একমাত্র উৎস। এগুলো ঠিক না থাকলে যেমন জৈব জীবন বাঁচে না, তেমনি সমাজ ঠিক না থাকলে মানবিক জীবন বাঁচে না।
সমাজ বদলাতে হয়, খুব ধীরে ধীরে সমাজ বদলাতে হয়। রাতারাতি সমাজ বদল করা যায় না, বিপ্লব করে রাতারাতি প্রশাসক বদলানো যায়, শাসন ব্যবস্থা বদলানো যায়, সমাজ বদলানো যায় না। সমাজের মধ্যে অন্তর্নিহীত প্রতিটি জীব যতক্ষণ না নিজেকে বদলানোর প্রয়োজন বোধ করবে ততক্ষণ সমাজ বদলাবে না।
সমাজের মধ্যে যারা বসবাস করে এরা সবাই সজ্ঞানে বসবাস করে না, ফলে প্রত্যেকে আলাদাভাবে নিজেকে বদলানোর জন্য প্রয়াসী হতে পারে না। এজন্য একটি ক্ষয়িঞ্চু সমাজ বদলাতে হলে কিছু মানুষের লাগাতার, এমনকি কয়েক প্রজন্ম ধরে এমন কিছু কাজ করতে হয়, যাতে সমাজের গড়পড়তা মানুষের নিজেকে বদলানোর সুস্পষ্ট কারণ খুঁজে পায়।
এই কাজগুলো যুগে যুগে যারা করে থাকেন, তাদেরকে আমরা মনীষী বা মহামনব বলে থাকি। এ ধরনের মানুষ একটি সমাজে খুঁজে না পাওয়া গেলে বা সমাজ তাদেরকে একেবারেই ধারণ করতে না পারলে বুঝতে হবে সমাজটা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের সমাজটা কি তাহলে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে?
এই যে বরগুনায় যে ঘটনাটা ঘটল—সম্পর্কের জের ধরে নয়ন বন্ড নামে এক যুবক প্রকাশ্য দিবালোকে অনেক মানুষের সামনে কুপিয়ে মারে আরেক যুবক রিফাত শরীফকে! এটাকে কোনোভাবে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা যায় না। এরকম ঘটনা কি হামেশাই আমাদের সমাজে ঘটছে না? এই ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছে বলেই জনপ্রতিক্রিয়া হয়েছে মারাত্মক। এরকম অনেক ঘটনাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে না, কিন্তু সেগুলো এই সমাজেই ঘটছে, অর্থাৎ বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ এক্ষেত্রে নেই।
খুনী মরেছে, তাকে হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু খুনের যে মনস্তত্ব, খুনের যে ব্রিডিং গ্রাউন্ড সেটি মরেনি, সমাজ না বদলালে সেটি মরবে না। সমাজের বিচার করা যায় না, সমাজকে ক্রসফায়ারে দেওয়া যায় না। ফলে একজন নয়ন বন্ডকে ক্রস ফায়ারে দিলে তাতে স্বস্তি পাওয়ার কিছু নেই, বরং এটিও আরেকটি হত্যাকাণ্ড–খুনী মরেছে, একইসাথে একজন মানুষ মরেছে, এই সমাজ মেরেছে, কারণ, এই সমাজই তাকে হত্যাকারী বানিয়েছে।
তাকে প্রশ্রয় দিয়ে, তাকে পেলে-পুষে যারা ব্যবহার করেছে, সমাজের যে দূষণীয় উপাদানগুলোর কারণে সমাজে এরকম এক একজন নয়ন বন্ড তৈরি হয়, হয়ে আছে, সেইসব মানুষদের সণাক্ত করা না গেলে, সেইসব দূষণীয় উপাদান সমাজ থেকে দূর করা সম্ভব না হলে আরেকজন নয়ন বন্ড পেতে সময় লাগতে পারে মিনিটেরও কম, খোঁজ নিলে দেখা যাবে এরকম হত্যাকাণ্ড ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে গেছে আরো কয়েকটি।
পুনশ্চ:
বেশ জনগণের অনুগামী সরকার। বেশ গণতান্ত্রিকই তো, তাই না? বেশিরভাগ জনগণ চেয়েছে নয়ন বন্ড কে ক্রসফায়ারে দিয়ে দেওয়া হোক, সরকার তাইই করেছে। অথচ জনগণ হিসেবে আমাদের মূল চাওয়া হওয়া উচিৎ ছিল নয়ন বন্ডের জবানবন্দীটা শুনতে চাওয়া, তারপর শাস্তি দেওয়া। সে সুযোগ আর থাকল না, সে সুযোগ রাখা হলো না।
এখানে একটা দেখার বিষয় আছে- নয়ন বন্ড হচ্ছে রাজনৈতিক ছত্রছায়া ছাড়া বেড়ে ওঠা সন্ত্রাসী, এরকম সন্ত্রাসীরা আগে বেড়ে ওঠে পরে ছত্রছায়া পায়, যে ছত্রছায়া আপন নয়, আন্তরিকও নয়, শুধু ব্যবহার করে।
অন্যদিক নয়ন বন্ডের সাথে অন্য যারা ছিল, বিশেষ করে হত্যাকান্ডে সরাসরি আর যে দুজন, (একজনের নাম সম্ভবত রিফাত ফরাজী) অংশ নিয়েছে তাদের রাজনৈতিক ছত্রছায়া অাপনজনের ছত্রছায়া, সেখানে স্বজনপ্রীতি আছে, ভালোবাসা আছে, তাই অনুমান করি যে এই ঘটনায় নয়ন বন্ড ছাড়া আর কেউ পুলিশের সাথে গোলাগুলি খেলায় মারা যাবে না।
শেকস্ রাসেল
লন্ডন, যুক্তরাজ্য