চোর
লাল টুকটুক দু’টো দুধের উপর সোনার হার চকচক করছে। হাতে সোনার বালা, কানে বিয়ের ঝুংকো, পায়ে নূপুর। গয়না পরা নগ্ন নববধু। স্বপ্নে দেখাও দুঃসাধ্য।
ডিম লাইটের লাল আলোয় সারা শরীর লালচে গোলাপী আভা পেয়েছে। এক পা খাটে তুলে নূপুর খুলছে।
– রাক্ষসের মতো করো না তো, নতুন পরেছি এগুলো খুলতে সময় লাগে। দেখো, কানের দুলটা কিছুতেই খুলতে পারছি না। একটু খুলে দিবা?
– আসো, খুলে দিই।
– বুঝতে পেরেছি, মাপ চাই।
– ও দু’টো থাকলে কিছু হবে না।
– হয়েছে, তাহলে কালকে আর বাইরে বের হতে হবে না।
– বুকের উপর অমন কালচে দাগ পড়েছে যে! কে চাপ দিয়েছে?
– আমার আর একটা বর আছে তুমি জানো না, সে ভূত হয়ে এসে চাপ দিয়েছে। এখন থেকে রোজ আসবে বলেছে।
– ভূত হয়ে আসলে সমস্যা নেই, জ্যান্ত ভূত এসে আবার হাজির হবে না তো?
– জ্যান্ত ভূত তো একটা আছেই। এইটা সামলাতেই তো দুইদিনে সব শর্ষে শেষ, এর ওপর আরো! এরকম রাক্ষসের মতো করবা জানলে বিয়ে করতাম না।
চোরটা ইঁদুরের মতো গর্তের মধ্য থেকে উঁকি মেরে আছে। টুকটুক করে এতক্ষণে সে ভালোই একটা গর্ত তৈরি করেছে। দূরে মাঠে কোথাও সেচের কাজ চলছে, সেচ মেশিনের শব্দের সাথে গর্ত খোড়ার ঢিপ ঢিপ শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে, তাই গর্ত খুড়তে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। এমনিতেই মাটি খোড়ার শব্দ এমন মারাত্মক কিছু নয়, তাছাড়া নব বর-বধুর মনোযোগ এখন এদিকে থাকার কথাও নয়।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো সে উঁকি মেরে আছে। অনেক্ষণ এভাবে থাকলে দম আটকে আসে, তাই মাঝে মাঝে মাথা বের করে শ্বাঃস নিতে হচ্ছে। কোনোমতে একটান বাতাস নিয়েই আবার গর্তের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে থাকছে। চোর জানে ঐ গয়নাগুলো দু’এক দিনের মধ্যেই সিন্দুকের মধ্যে চলে যাবে। তখন আর ওগুলো চুরি করে নেওয়া সম্ভব নয়। বউয়ের পরামর্শমতো সে মাঝরাতে এসেছে। বউ মাঝেই মাঝেই তাকে এরকম ভুল পরামর্শ দেয়। নতুন বিবাহিতদের বাড়িতে শেষ রাতে আসতে হয়। নব বিবাহিতরা প্রথম রাত থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত প্রেম করে। সেও তাই করত। চোর নিজের বিয়ের কথা ভাবতে চায়, সব মনে পড়ে না। আবছা-আবছা কিছু মনে আছে। বউয়ের কথা ভাবে। বউয়ের জন্য তার দুঃখ হয়। বউয়ের শরীরটা সে কোনোদিন বুঝতে পারলো না। চুরি করে সংসার চলে। সপ্তাহে একবার ভালোমতো চুরি করতে না পারলে মনও ভালো থাকে না, সংসারও ভালো চলে না। বউকে একটু ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ কোনোদিন তার হল না, চোর আফসোস করে।
নববধু এতক্ষণে কানের দুল খুলতে সমর্থ হয়েছে। কোন ফাঁকে গয়নাগুলো লুকিয়েও ফেলেছে। মেয়েদের এ এক অসম্ভব ক্ষমতা, মুহূর্তের মধ্যে কোথায় যে তারা লুকায়! দম আটকে আসছে। এই পোতাটা বোধহয় অনেক পুরনো। মাটির গন্ধটা বিশ্রী। চোর নাক সিটকায়। নিঃশ্বাস নিয়ে আবার মাথা ঢুকায়।
বিস্ময়ে চোরের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে আসছে। নগ্নতার এত রূপ! কই, নিজের বউটাকে তো কোনদিন এভাবে দেখা হয়নি। মশারির মধ্যে শুয়ে থাকা ঐ ব্যাটাও বোধহয় দেখছে না। নববধু চুল বাঁধছে। এ রূপের বর্ণনা হয় না। এ রূপ কাব্যিকতাকেও হার মানায়। এ একটা স্বপ্ন, শুধুই স্বপ্ন। চোর বলেই এ দৃশ্য তার দেখার সৌভাগ্য হলো, নইলে মধ্য রাতে পড়শীর নববধুর নগ্ন শরীরে চুল বাঁধার দৃশ্য দেখা কম সৌভাগ্যের কথা নয়।
– লাইট থাকুক।
– ইস, লজ্জা লাগে না বুঝি। লজ্জা! দেখি কোথায় লজ্জা …?
গর্তের মধ্যে ঘাড় ঘুড়িয়ে চোর কিছুতেই খাটের উপরে আর চোখ রাখতে পারছে না। এখন সে শুধু কথা শুনছে। আরে ভালোবাসার সময় বউকে তো আমিও এসব কথাই বলি। আমি না চোর? তাহলে? বাবুদের ভালোবাসা আর চোরের ভালোবাসায় কোনো তফাৎ থাকবে না? আরেকটু শুনি তো— নাহ্! আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। এই ভালোবাসা বোধহয় সবার তাহলে একই রকমেরই হয়। ঘাড় ব্যথা হয়ে গিয়েছে। ব্যথার সাথে মোটা মোটা হার বালার কথাও এখন মনে পড়ছে।
তবে সোনা চুরি করতে না পারার জন্য চোরের আজ একটুও দুঃখ হচ্ছে না। দুঃখ হচ্ছে বউয়ের জন্য। বউয়ের শরীরটা কোনোদিনই সে বুঝতে পারলো না। চৈত্রের শেষ রাতে আকাশে পূর্ণ চাঁদ উঠেছে। চাঁদ দেখায় চোরের মন নেই। জ্যোৎস্না হতে নিজেকে লুকাতে হবে। বাগানের পথে সে যাওয়া আসা করে। বাগানেও আজ ছায়া ছায়া জ্যোৎস্না।
নাহ, আজ আর বেশি সতর্ক হতে ভালো লাগছে না। যা হবার হোক। ভাবতে ভাবতে চোর বাড়িমুখে হাঁটছে। আজ তো বউ খুব হতাশ হবে। চুরি মিললে সে খুব খুশি হয়। না মিললে হতাশা গোপন রাখে না, তাতে চোরের পরের দিন ভালো চুরি করার জন্য জিদ চেপে বসে। চুরি করে ফেরার পর বউটা কেমন জানো নকল হাসি হাসে। চুরি করে ফেরার পথে হাঁটতে হাঁটতে বউকে নিয়ে সে ভাবে। দশ বছরেও সে বউয়ের কোনো কূল কিনারা করতে পারলো না। শুধু জানে ভালো চুরি করতে পারলে বউ খুশি হয়। তাই চুরি করার দিকেই তার বেশি মনোযোগ। সংসার চালানোর দায় আছে, বউকে খুশি করতেও সে চায়।
বউকে চোর খুব ভালোবাসে। বউ তাকে চুরি করতে উৎসাহ দেয়। আম, কাঁঠাল, নারকেল, সুপারি, হাঁস-মুরগী, সব চুরিতেই বউয়ের সায় আছে। রাত দুইটা বাজলেই বউ তাকে ঠেলতে থাকে। গরমের রাত সকাল হলো বলে, এখন যাও, বউকে তো পরেও ভালোবাসতে পারবা। শীতের রাতে বলে, এত বড় রাত, শেষ রাতে সবার ঘুম ভেঙে যায়, তাড়াতাড়ি কাজ সেরে ফিরে আসো।
আজকে বউ তাকে চারটের আগে ফিরতে না করেছিলো। বলেছিলো, শুনেছি সাড়ে তিনটার সময় ঐ ঘরের ভাবী বিদেশে তার জামাইয়ের সাথে কথা বলে। চোর নিজে কোনোদিন কথা বলতে শোনেনি। তাতে কী, বউয়ের সব কথায় তার শতভাগ আস্থা আছে। তাছাড়া রোজ তো কথা বলার দরকার নেই। একদিন দেখলেই সর্বনাশ।
কিন্তু চোরের আজকে কিছুতেই আর বাইরে থাকতে ইচ্ছে করছে না। হনহন করে সোজা ঘরমুখো হাঁটতে শুরু করে। বউয়ের কথাগুলো খুব মনে পড়ছে। বউ তাকে বলে, দেখো, মাত্র দুই বছর হলো তুমি চুরি করছো। আরো দুই বছর এভাবে চালাতে পারলে বাকি দিনগুলো আমরা সুখে শান্তিতে থাকতে পারবো। তখন তোমাকে প্রাণ ভরে ভালোবাসবো।
চোরের হিসাব মেলে না। চুরি করে যা সে আনে তাতে কোনমতে সংসার চলে যাওয়ার কথা, বাড়তি থাকার তো কথা না। যাইহোক, হিসেবি বউয়ের প্রতি সে কৃতজ্ঞ হয়। নাকি বউও কিছু চুরি টুরি করে? চোর চিন্তায় পড়ে যায়।
আচ্ছা, প্রথম দিকে তো বউ চুরিতে আপত্তি করত। মাস ছয়েক হলো চুরিতে আমার চেয়ে তার আগ্রহ বেশি। নাহ! বউটাকে আমি কোনোদিনই বুঝতে পারলাম না।
চুরি করতে ইচ্ছে না করলে সে ঐ পাড়ার সেলিম মাঝির নৌকায় গিয়ে গল্প করে। একদিন সময়ের আগে ফিরে ডাকাডাকি করে বউকে উঠাতে না পেরে রাস্তায় হেঁটে বেড়িয়েছিলো। তারপর থেকে বউয়ের কথামতো চারটের আগে বাড়ি ফেরে না।
সেলিম মাঝির কথা এই গ্রামের সবাই জানে। তার পরিবার নেই। নৌকা চালায়, নৌকায়ই ঘুমায়। তার কাছে রাত বেরাত এসে বসে থাকলে সে বিরক্ত হয় না, লোকেও কিছু মনে করে না। ভালো মানুষ হিসেবে তার ডাকনাম আছে। তার কাছে সে যে মাঝে মাঝে চুরির মাল রাখে একথা লোকজনের মাথায় আসে না।
আজকে আর মাঝির কাছে যেতে ইচ্ছে করছে না। রাত তিনটে বাজে, খালি ছালা নিয়ে ঘরে ফিরলে বউয়ের মুখ বেজাড় হবে। যে সম্পদ মস্তিস্কে সে আজ নিয়ে ফিরছে তাতো আর বউকে দেখানো সম্ভব না, বলেও বুঝানো যাবে না। যদিও চোর বউকে ঘটনাটা বলবে ঠিক করেছে।
নববধূর লালটুকটুকে নগ্ন শরীর কিছুতেই সে ভুলতে পারছে না। ঘরে ফিরে সে বউকে ওভাবে সাজিয়ে দেখতে চায়। সোনাদানার কথা সে বেমালুম ভুলে গিয়েছে। মনে পড়ছে নববধূর গোলাপী দুধ দু’টো, মনে পড়ছে খাটের উপর এক পা তুলে নূপুর খোলার দৃশ্য, মনে পড়ছে দু’বাহু উপরে তুলে চুল বাঁধার দৃশ্য।
চোর হোক আর ফকির হোক পৃথিবীতে এমন পুরুষ কি একজনও আছে যে এসব ভুলে সোনাদানার নাম জপ করবে? শেষ রাতের জ্যোৎস্নায় বাড়িটি দেখা যাচ্ছে। পাতলা টিনের উপর চাঁদের আলো বিচ্ছুরিত হয়ে জ্যোৎস্না আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
চারটের পরে দরজা খুলে বউ তার জন্য অপেক্ষা করে। চোর কত বারণ করেছে, কিন্তু বউ কিছুতেই শোনে না। বলে, তুমি বাইরে এত কষ্ট করো আর আমি তোমার জন্য এতটুকু করতে পারবো না। বউ এক অদ্ভুত বুদ্ধি করেছে, সে পিছনের দরজা খুলে রেখে সামনের বারান্দায় বসে থাকে। সামনের দরজা খুলে বসতে নাকি তার ভয় করে।
এতক্ষণ চোর নিচু হয়ে হাঁটছিল। হঠাৎ মাথা তুলে দেখে কে যেন তার বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। কথা বলার সাহস করে না। ভাবে, সেও নিশ্চয়ই চোর। চেনা কেউ হলে দু’জনেই লজ্জা পেতে হবে। গাছের ফাঁক দিয়ে এক চিলতে চাঁদের আলো এসে পড়ায় আগন্তুককে সে চিনতে পেরেছে। চোর জোর পায়ে হেঁটে বাড়ি ঢোকে। বউ তড়িৎ সামনের দরজা খুলে দেয়। চোর ভাবতে থাকে— বউ আজকে কেন সামনের দরজা খুলে দিলো?
ডিসেম্বর ২০০৯, রুম নং-৩৬, জগন্নাথ হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।