কুড়িগ্রামে খ্রিস্টান মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকান্ডে জড়িত জেএমবি সদস্য গ্রেপ্তার

Jmb_kurigram
রাইহান রনোঃ গতকাল সোমবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে রংপুর জেলার কাউনিয়া বাসষ্ট্যান্ড এলাকা থেকে কুড়িগ্রামে মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলী হত্যাকান্ডে জড়িত অন্যতম জেএমবি সদস্য হাসান ফিরোজকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাকে আটকের মধ্যদিয়ে হত্যাকান্ডের মূল রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। হত্যাকান্ডে আইএস জড়িত দাবি করলেও পুলিশের তদন্তে বেড়িয়ে এসেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবি’র জড়িত থাকার প্রমাণ। মূলত খ্রিস্টান মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলী হত্যাকান্ডে জেএমবি’র মুল মোটিভ ছিল দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি। সরকারকে বেকায়দায় ফেলে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে ব্যহত করা। বিদেশে দেশের সুনাম বিনষ্ট করা। এছাড়াও তাদের শক্তি পরীক্ষাও অন্যতম কারণ ছিল। ঘটনা সংঘটিত হওয়ার এক মাস ১০ দিন পর হত্যাকান্ডের অন্যতম আসামী জেএমবি’র কিলার গ্রুপের সদস্য হাসান ফিরোজ (২৩) কে গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হয় পুলিশ। তাকে বিকাল সাড়ে ৫টায় চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে হাজির করলে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমুলক জবানবন্দিতে নিজের দায় স্বীকার করে হাসান ফিরোজ। জেএমবি’তে তার কোড নেইম মোখলেছ।
সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয়। পুলিশ সুপার মোহাম্মদ তবারক উল্ল্যাহ্ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলার বাদাই ইউনিয়নের সারপুকুর গ্রামের রিয়াজুল ইসলামের পুত্র হাসান ফিরোজ হত্যাকারিদের রিসিভ করে এবং নিরাপদে পালিয়ে যেতে সহায়তা করে। সে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগে অনার্সের ৩য় বর্ষের ছাত্র। শহরের ভকেশনাল মোড়ে একটি ছাত্রাবাসে থাকত। তার বাবা রিয়াজুল ইসলাম লালমনিরহাট সাপটিবাড়ী কলেজের শিক্ষক।
তিনি আরো জানান, সোমবার ভোর ৫টার দিকে রংপুর জেলার কাউনিয়া বাসষ্ট্যান্ড এলাকা থেকে হাসান ফিরোজকে গ্রেপ্তার করা হয়। হত্যাকান্ডের পর থেকে সে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। গত ২৮ এপ্রিল গ্রেপ্তারকৃত অপর দুজন জেএমবি সদস্য আবু নাশির ওরফে রুবেল (২০) ও মাহাবুব হাসান মিলন (২৮) রিমান্ডে যে সব তথ্য দিয়েছে তাতে হত্যাকান্ডের পুরো ঘটনা উন্মোচিত হয়েছে। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা অপর আসামীদের আইনের আওতায় আনা। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে হাসান ফিরোজকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ নিয়ে এ হত্যা মামলায় ৩ জনকে গ্রেপ্তার করল পুলিশ। তাদের সবাই জেএমবি’র সক্রিয় কর্মী।
পুলিশ সুপার বলেন, পুলিশের দীর্ঘ তদন্তে এবং তথ্য উপাত্ত্বে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়, নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবি এ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত। চারটি গ্রুপে ১০/১২জন সদস্য অংশ নেয় এ হত্যাকান্ডে। মুল হত্যাকান্ডে অংশ নেয় ৩জন। এর মধ্যে অন্যতম পরীকল্পনাকারী ও তথ্য সরবরাহকারী ছিল নিহত মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলীর বাড়ির ভাড়াটিয়া আবুল বাশির। এটি তার জেএমবি’র কোড নেইম। রংপুর জেলার মাহিগঞ্জে তার বাড়ি। এই আবুল বাশির মুল ঘাতক। তাকে খুঁজছে পুলিশ। এ হত্যাকান্ডের আগে তারা চারটি বৈঠক করে। এর মধ্যে ২টি গাইবান্ধায়, একটি লালমনিরহাটে এবং সর্বশেষ ২১মার্চ রাতে হত্যার চুড়ান্ত বৈঠক হয় কুড়িগ্রামে। এই হত্যাকান্ডে তিনজনের গ্রুপটি সরাসরি অপারেশনে অংশ নেয়। অপর গ্রুপটি হত্যাকারীদের রিসিভ করে। একটি গ্রুপ তাদের আশ্রয় দেয়, অস্ত্র সরবরাহ করে। সর্বশেষ গ্রুপটি হত্যাকারীদের নিরাপদে পালিয়ে যেতে সহায়তা করে।
মূলত হোসেন আলী জেএমবি’র হত্যাকান্ডের টার্গেট ছিল না। তিনি হন পরিস্থিতির শিকার। জেএমবি’র হাই কমান্ড থেকে আবুল বাশিরের উপর সিদ্ধান্ত আসে কুড়িগ্রাম অথবা লালমনিরহাট জেলায় একটি কাজ করবার (হত্যাকান্ড)। লালমনিরহাটে ব্যর্থ হয়ে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রাম শহরের গাড়িয়ালপাড়ায় মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলীর বাসার একটি রুম ভাড়া নেয় আবুল বাশির। খুঁজছিল টার্গেট কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে শিকারীর কাছেই হোসেন আলী তার ধর্মান্তিরিত হওয়ার ইতিহাস তুলে ধরে। শুধু তাই নয় এক পর্যায়ে সন্তানতুল্য আবুল বাশিরকে ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহন করার আহবান জানায়। এরপরই টার্গেটে পরিণত হয় হোসেন আলী। আবুল বাশির হোসেন আলীর সাথে প্রাতভ্রমণে কয়েকদিন সঙ্গি হয়। গড়ে তোলে নিবিড় সম্পর্ক। তার গতিবিধি সবজেনে হত্যার চুড়ান্ত পরিকল্পনা আঁটে।
জেলা পুলিশের সহকারি পুলিশ সুপার মাসুদ আলম জানান, গ্রেপ্তারকৃত জেএমবি সদস্য আবু নাশির ওরফে রুবেল (২০) পিতা আজিজুল ইসলাম গ্রাম ও ইউনিয়ন সারপুকুর উপজেলা আদিতমারী, জেলা লালমনিরহাট। সে লালমনিরহাট সরকারি কলেজের বিএসএস’র ১ম বর্ষের ছাত্র। মাহাবুব হাসান মিলন (২৮), পিতা আব্দুল করিম, গ্রাম- পলাশবাড়ী মুন্সিপাড়া, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা। সে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে বিএসসি’র ছাত্র। দুজনকেই গত ২৮ এপ্রিল ৮দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। তাদের কাছ থেকে হত্যাকান্ডের গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্যই পাওয়া গেছে। পুলিশ পুরো ঘটনাই উদ্ঘাটন করতে পারলেও গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজনকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
উল্লেখ্য, গত ২২ মার্চ কুড়িগ্রাম পৌরসভার গাড়িয়াল পাড়ার (গড়ের পার) বাসিন্দা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মুক্তিযোদ্ধা হোসেন আলী (৬৮) প্রতিদিনের মত সকাল ৭টার দিকে বাড়ীর সামনে হাঁটছি্লেন। এ সময় কালো রঙের ১৩৫ সিসি ডিসকভার মোটর সাইকেলে তিন আরোহী পিছন থেকে অর্তকিত এসে গলা কেটে হত্যা করে। পরে মৃত্যু নিশ্চিত হবার পর ককটেল ফাটিয়ে এলাকায় আতংক সৃষ্টি করে কলেজ পাড়া ও বকসী পাড়া দিয়ে পালিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায় ৪ থেকে ৫ মিনিটের ছিল এই অপারেশন।