অর্থনীতির সরল পাঠটুকু গ্রামের শিক্ষিত মানুষের অন্তত বোঝা দরকার

অর্থনীতির সরল পাঠটুকু গ্রামের মানুষের, বিশেষ করে শিক্ষিত মানুষের বোঝা দরকার। একটি দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি যেমন রক্ষা করা লাগে, আমার মনে হয়েছে— একটি গ্রামের অর্থনীতিও রক্ষা করার বিষয় আছে।

একজন লোক তার বাড়ি থেকে এক বোতল মধু নিয়ে অন্য কোনও জেলার গ্রামে তার আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে গেল, এর মানে কিন্তু ঐ আত্মীয়র গ্রামকে সে এক তিল হলেও সমৃদ্ধ করল, প্রত্যক্ষভাবে এতে লাভবান হল তার আত্মীয়, কিন্তু পরোক্ষ লাভ আছে অর্থনীতির ছোট্ট ঐ আঞ্চলিক কাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভূক্ত সবার। এটা সে ফ্রি না দিয়ে যদি বিক্রি করত, তাহলে লাভ হত উল্টে তার নিজ গ্রামের।

অন্যভাবে বোঝার চেষ্টা করি— ধরা যাক, মসনি নামক গ্রামের একটি ছেলে ঢাকায় পড়াশুনা করে, তার পিতা তাকে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা করে পাঠায়। এতে নিশ্চয়ই ঐ গ্রামের অর্থনীতি দুর্বল হচ্ছে। হচ্ছে না? তবে বিষয়টিকে বিনিয়োগ ভাবা যেতে পারে। পাঁচ বছরে তার পিছনে বিনিয়োগ হয়েছে ৩ লক্ষ টাকা। পড়াশুনা করে চাকরি পেয়ে সে বাড়ি পাঠাতে শুরু করল মাসে ১০ হাজার টাকা। আপাতভাবে লাভটা ঐ পরিবারের মনে হলেও, পরোক্ষভাবে লাভ কিন্তু আশেপাশের অনেকেরও, প্রকৃতপক্ষে নির্দিষ্ট ঐ অর্থনৈতিক কাঠামোর সকলেরই লাভ।

এখন যদি ঐ ছেলেটি বা মেয়েটি উপার্জনক্ষম হওয়ার পর ফিডব্যাক না দেয়, তাহলে কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে ঐ গ্রামটি ক্ষতিগ্রস্থ হল। হল কিনা? গ্রাম থেকে টাকা বেরিয়ে গিয়েছে, কিন্তু বিপরীতে টাকা ঢুকছে না। হিসেব খুব সহজ।

এবার আসি মূল জায়গায়— যখনই গ্রামে যাচ্ছি, মোড়ের দোকানে দেখছি সেখানে শহরের দোকানে যেসব অপ্রয়োজনীয় বাহারী পণ্য থাকে তার সবই আছে, অর্থাৎ গ্রাম থেকে টাকা বেরিয়ে যাওয়ার পথটা বড় হয়েছে, এবং বর্তমান সময়ের একমুখী ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমেও গ্রাম দুর্বল হচ্ছে, কারণ, মোবাইলের মাধ্যমে প্রতিদিন প্রচুর টাকা গ্রামের অর্থনীতি থেকে বের হয়ে আসছে। এটা ঘটছে গ্রামের মানুষের একেবারে অজান্তে।

আমি যখন বছর পাঁচেক আগে গ্রামে বাড়ি ঘর ঠিক করতে ছিলাম— একটু খরচ করে একটা টয়লেট-বাথরুম বানাচ্ছিলাম, তখন আশেপাশের অনেকেই সেটি সহ্য করতে প্রস্তুত ছিল না। তাদের ধারণা— এতে তারা ছোট হয়ে যাচ্ছে। অনেকে তো প্রশ্ন করেই বসল, বাড়ি থাকো না তো এত টাকা খরচ করার দরকার কী?

আমার কী দরকার সেটি আমি জানি, তাদেরও কেন দরকার সেই জবাবটা বরং দিই। ঐ বাথরুমটি বানাতে ধরি ১ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। দেখা যাক, টাকাটা কোথায় কোথায় খরচ হয়েছে। ধরলাম, সরঞ্জাম বাবদ গিয়েছে ৭০ হাজার টাকা। এই পণ্যগুলো আমি স্থানীয় বাজার থেকে কিনেছি, যদি এখান থেকে ঐ দোকানদার ১০ হাজার টাকা লাভ করে থাকে, তাহলে নিটলি ঐ ১০ হাজার টাকা অর্থনীতির নির্দিষ্ট ঐ আঞ্চলিক কাঠামোতে যোগ হয়েছে।

সম্ভাবনা আছে লাভের টাকা দিয়ে একটু বেশি দরেই সে একটা মুরগি কিনেছে, এবার আমার বিনিয়োগের ছোট্ট একটু লাভ ভোগ করল ঐ এলাকার এক মুরগি পালনেওয়ালা। মুরগিওয়ালা মুরগিটা একটু ভাল দামে বিক্রি করতে পারায় মেয়ের জন্য ২০ টাকা দিয়ে একখান আয়না কিনল। এবার আমার বিনিয়োগের লাভ ভোগ করল ঐ মেয়েটি এবং আয়না বিক্রেতা।

আর যে ৩০ হাজার টাকা, সেটি তো সরাসরি ঐ এলাকার শ্রমিকরাই পেয়েছে মজুরী বাবদ। অর্থাৎ, প্রত্যক্ষভাবে কমপক্ষে ৪০ হাজার টাকা আমি ঐ গ্রামের অর্থনীতিতে যোগ করেছি, যার সুবিধা অর্থনীতির ঐ কাঠামোর মধ্যে থাকা লোকজনই পাবে।

একটা বইয়ের দোকান করেছিলাম বাধাল বাজারে, সেটিও ওখানকার লোকজন ওয়েলকাম করেনি। একটা ভালো বইয়ের দোকান এলাকায় থাকলে কী লাভ হতে পারে সেটি অনেক মানুষে সহজে বুঝবে, কিন্তু অর্থনীতির হিসেবটি হয়ত অনেকেই বুঝবে না।

এখানেও গ্রামের অর্থনীতির বিশাল লাভালাভের বিষয় আছে। এবং সে লাভটা হত লাগাতার, কারণ, আমি তো মাঝে মাঝে টাকা ঢুকাতাম ছাড়া কোনও লাভ কখনও তুলে আনতাম না। তাছাড়া ওখানে এমন কিছু হতও না। যাইহোক, যে চার লক্ষ টাকা আমি ওখানে ‘নষ্ট’ করেছি, তা অবশ্যই ঐ অঞ্চলের অর্থনীতিতেই যুক্ত হয়েছে।

বইয়ের দোকান ওয়েলকাম না করলে কী হবে তারা ওয়েলকাম করছে টাইগার, স্পিড (এনার্জি ড্রিংক), চিপস, আইসক্রিম ইত্যাদি পণ্য, এছাড়া অনেক ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস তো আছেই, যা খুব সুক্ষ্মভাবে গ্রামের অর্থনীতি কাবু করে দিচ্ছে, কারণ, শহরে বসে ডিলার বা প্রডিউসার হিসেবে এসব ব্যবসা যারা করছে, তারা গ্রামে কখনও বিনিয়োগ করবে সে বিশ্বাস করা কঠিন। বরং টাকা চলে যাবে হয়ত থাইল্যান্ডের পাতায়ায়, বা এরকম কোথাও, হতে পারে তা হংকং-এর কোনও ক্যাসিনোতে, অথবা কানাডার মন্ট্রিল বা টরেন্টোতো। অর্থাৎ আমাদের কৃষক শ্রমিকের রক্তঘামের পঁজি চলে যাবে দুবৃত্তের হাত ধরে সুদূর কানাডায়, সমৃদ্ধ হবে কানাডার অর্থনীত।


দিব্যেন্দু দ্বীপ

লেখক, গবেষক

Dibbendu Dwip