কেরানীগঞ্জ ভূমি অফিসে দুর্নীতির শেষ নেই

follow-upnews
0 0

ঢাকার কেরানীগঞ্জ ভূমি অফিসগুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ বিস্তর। সরকারি ওয়েবসাইট নকল করে ভুয়া ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের ঘটনা ঘটছে এই অফিসে। তাছাড়া ভূমি অফিসের নামজারি সহকারীর সোহেল রানার টেবিলে আর্থিক লেনদেনের দৃশ্য চোখে পড়ে। এই অফিসে ই-নামজারি করতে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা, ভূমি উন্নয়ন কর রসিদের বাইরে অতিরিক্ত অর্থ আদায়। এছাড়া মিসকেসের রায় মিলে টাকায়।
জানা গেছে, জমির নামজারি করতে সরকারের নির্ধারিত ফি ১১৭০ টাকা। কিন্তু ওই অফিসগুলোতে ই-নামজারি করতে লাগে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। এছাড়া ‘খ’ তালিকাভুক্ত জমির নামজারির ক্ষেত্রে খরচ পড়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা।
হেলাল উদ্দিন নামে এক ভুক্তভোগী জানান, সরকার ভূমি সেবাকে ডিজিটালাইজড করেছে। এতে ভূমি সেবা সহজ হয়েছে। অথচ বিষয়টিকে জটিল করে দিচ্ছে ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা। নিজের জমির ভূমি উন্নয়ন কর নিজেই দেবো এ জন্য অনলাইনে নিবন্ধন করি। পরে অনুমতির জন্য শুভাঢ্যা ভূমি অফিসে গেলে তারা জানান, আমার নামজারি খতিয়ানের পর্চায় অনেকগুলো নাম। এগুলো এন্ট্রি করতে হবে। এখন হবে না। পরে নিতে হবে। আর এ জন্য ২৫০০ টাকা দিতে হবে। অতিরিক্ত টাকা চাওয়ায় আমি ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধ না করেই চলে আসি।
সরকারি নীতিমালা উপেক্ষা করে অতিরিক্ত হারে দাবিকৃত ঘুষ না দিলে সেবা পায় না মানুষ। এছাড়া বড় অঙ্কের অর্থ আদায় করা হয় উপজেলা ভূমি অফিসে।
জমির নবায়ন ফি, ভূমি উন্নয়ন কর ও মিসকেস করতে সরকার নির্ধারিত ফির কয়েকগুণ বেশি অর্থ না দিলে কাজ হয় না বলে জানান সেবা গ্রহীতারা। তাদের অভিযোগ মিসকেস তদন্তের জন্য কোনো কর্মকর্তা সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে তাকে যাতায়াত ও চা-নাস্তা খরচ বাবদ দুই থেকে তিন হাজার টাকা দিতে হয়। তদন্ত শেষে প্রতিবেদনের জন্য দিতে হয় ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা। আর উপজেলা ভূমি অফিসে রিপোর্ট গেলে টাকার বিনিময়ে মিসকেসের রায় এনে দেয়ার চুক্তি করেন অফিসটির নাজির ও মিসকেস সহকারী আনোয়ার হোসেন।
শুভাঢ্যা ইউনিয়ন ভূমি অফিসে গিয়ে জানা গেলো সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা পাঁচজন, কিন্তু অফিসটিতে দেখা গেলো ১০ থেকে ১২ জন যুবক চেয়ার-টেবিল নিয়ে কাজ করছেন। বহিরাগতদের দখলে অফিসের রেকর্ডরুম। আর ভূমি অফিসে আসা সেবা গ্রহীতারা কাগজপত্র নিয়ে তাদের পিছেই ছুটছেন।
কোন্ডা ইউনিয়নের বাসিন্দা মো: এসবার হোসেন সারোয়ার জানান, শুভাঢ্যা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা আফরোজা খাতুন ভূমি উন্নয়ন কর বাবদ তার কাছে ৯ হাজার টাকা দাবি করেন। পরে তিনি ৭ হাজার টাকা দিলে তাকে রসিদ দেন ৪ হাজার ৭৮২ টাকার। এর আগেও অফিসটির আরেক ভূমি সহকারী কর্মকর্তা রনজিত চন্দ্র নাথ অতিরিক্ত টাকা নিয়ে কম টাকার রসিদ দিয়েছেন বলে অভিযোগ এই ভুক্তভোগীর। তিনি আরো জানান, সরকারি ফি থেকে বেশি টাকা না দিলে কাজ হয় না এখানে। বেশি টাকা কেন দেবো বললে দুর্ব্যবহার করে অফিস থেকে বের করে দেন।
আরেক ভুক্তভোগী শুভাঢ্যা ইউনিয়নের কালিগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা মো: গোলাম হাসান জানান, নিজের নামজারি নিজে করতে গেলে এটা নাই সেটা নাই বলে হয়রানি করেন। তাই বাধ্য হয়ে লোক ধরতে হয়। এতে নামজারি করতে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা লেগে যায়। তিনি জানান, তার নিজের নামে নামজারির আবেদন করে নথি জমা দেয়ার পর শুভাঢ্যা ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে তার সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে বণ্টননামা দলিল নিয়ে দেখা করতে বলেন। পরে দলিল নিয়ে ভূমি সহকারী কর্মকর্তা রনজিত চন্দ্র নাথের সাথে দেখা করলে তার আবেদনটি বাতিল হয়েছে বলে নতুন করে পুনরায় আবেদন করতে বলেন। দ্বিতীয়বার আবেদন করে অফিসে যাওয়ার পর ভূমি কর্মকর্তা তার সহকারী ইমরানের সাথে কথা বলতে বলেন। তার কাছে গেলে তিনি জানান, রিপোর্ট নিতে এক থেকে দেড় হাজার টাকা খরচ লাগে। তাই এক হাজার টাকা দিতে হবে। টাকা কেনো দিতে হবে জানতে চাওয়া হলে ইমরান বলেন তাদের বেতন নেই। তাই চা-নাস্তা ও অফিস খরচ বাবদ এটা দিতে হবে। পরে তিনি টাকা দেয়ার পর বণ্টননামা দলিল ছাড়াই নথি উপজেলা ভূমি অফিসে পাঠানো হয়। ভুক্তভোগীর অভিযোগ, টাকা দিলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। আর না দিলে নতুন করে একটার পর একটা সমস্যা সৃষ্টি করা হয়। এই অফিসে হোল্ডিং খোলার জন্যও দিতে হয় ২০০ টাকা, একটা খসড়া তুলতে গেলেও দিতে হয় ১০০ থেকে ২০০ টাকা। নামজারি করার পর ভূমি উন্নয়ন কর দিতে গেলে এক কর্মকর্তা বলেন ৬ হাজার টাকা আরেকজন বলেন ২৬ হাজার টাকা। পরে তার কাছ থেকে সঠিক ভূমি উন্নয়ন কর বাবদ রাখা হয়েছে পাঁচ হাজার ১৫০ টাকা।
মো: মালেক নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘মিসকেসের রায়ের জন্য উপজেলা দক্ষিণ ভূমি অফিসের নাজির ও মিসকেস সহকারী আনোয়ার আমার কাছ থেকে ১২ হাজার টাকা চেয়েছে। আমি গরিব মানুষ তিন হাজার টাকা দিয়েছি বাকি টাকার জন্য কাজটি আটকে রেখেছে।’ আরেক ভুক্তভোগী জানান, সব কিছু ঠিক থাকার পরও টাকা না দেয়ায় তার নামজারি আটকে ছিল অথচ যারা টাকা দিয়েছে সবার নামজারি হয়ে গেছে।
তবে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ অস্বীকার করে ভূমি সহকারী কর্মকর্তা রনজিৎ চন্দ্র নাথ জানান, অফিসটিতে অতিরিক্ত দালাল থাকার কারণে কে প্রকৃত সেবা গ্রহীতা আর কে দালাল সেটি আলাদা করা সম্ভব হচ্ছে না। আর অতিরিক্ত টাকা দালালরা নিচ্ছে দাবি করে তিনি জানান, জনবল সঙ্কটের কারণে তার অফিসে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বাইরেও অতিরিক্ত দুই-তিনজন লোক কাজ করছেন। এছাড়া দুইজন কম্পিউটার অপারেটরকে নিজেদের বেতন থেকে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দেয়া হচ্ছে। সরকারি ওয়েবসাইট নকল করে ভুয়া ভূমি উন্নয়ন কর আদায়ের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, দীর্ঘদিন তার অফিসে কম্পিউটার অপারেটর হিসাবে যিনি কাজ করতেন তিনি সরকারি ওয়েবসাইটের আদলে হুবহু ওয়েবসাইট নকল করে ভুয়া ভূমি উন্নয়ন কর আদায় করে অনলাইন থেকে রসিদ প্রদান করেন। বিষয়টি ধরা পড়ার পর তাকে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ১৫ দিনের জেল দেয়া হয়।
এ বিষয়ে কেরানীগঞ্জ দক্ষিণের এসিল্যান্ড আমেনা মারজান নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা অনলাইনে নামজারি করছি। বর্তমানে আইডিও আমার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অনিয়মের সুযোগ নেই। এছাড়া কোনো ভূমি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।


নিউজটি ৪ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

Next Post

যে তিন স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ

স্বাধীনতার পর পঞ্চাশ বছরে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক সাফল্য এসেছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকগুলোতে বেশিরভাগ দিক থেকে পাকিস্তানকে এবং অনেক দিক থেকে ভারতকে পিছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। যেমন- মাথাপিছু আয়ে ভারত ও পাকিস্তানকে পিছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। উৎপাদন খাতেও ভারত পাকিস্তানকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। নারীর কর্মসংস্থানেও এখন বাংলাদেশ এগিয়ে। ভারক পাকিস্তানের […]
rmg