পিতা-মাতা-পুত্র মিলে এ এক দানব পরিবার

follow-upnews
0 0

কাপড় ধোয়ার সময় এক কাপড়ের রঙ অন্যটিতে লেগে যাওয়াই ছিল অপরাধ। এ অপরাধে প্রথমে গৃহকর্তা ও তার ছেলের হাতে মারধরের শিকার হন গৃহকর্মী ফাতেমা। এরপর গৃহকর্ত্রী তার গায়ে ঢেলে দেন ফুটন্ত গরম পানি। এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার ভয়ে ওই গৃহকর্মীকে আটকে রাখা হয় বাথরুমে, গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আর প্রচার করা হয়, নিজেই গায়ে আগুন ঢেলে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে ওই গৃহকর্মী। এত কিছুর পরেও গৃহকর্তা ও তার পরিবারের দয়া হয়নি। ফাতেমাকে ভর্তি করা হয়নি নিকটস্থ কোনও হাসপাতালে। ঢাকা থেকে সোজা তাকে নিয়ে যাওয়া হয় খুলনায়, সেখানকার খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ফেলে দায় সারেন ওই গৃহকর্তা।

অমানবিক নিষ্ঠুর এই ঘটনার শিকার গৃহকর্মী ফাতেমা। প্রায় নয় মাস আগে অভাবের তাড়নায় রাজধানীর দক্ষিণ কেরানীঞ্জের হাসনাবাদ এলাকার জনৈক দেলোয়ার হোসেনের বাসায় কাজ নিয়েছিলেন স্বামী পরিত্যক্তা ওই তরুণী। তিনি বাগেরহাটের মংলার সিগনাল টাওয়ার এলাকার মোজাম সরদারের মেয়ে। গত বৃহস্পতিবার (১৬ মার্চ) সকালে তিনি ওই পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন।

খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় লোমহর্ষক এ ঘটনার কথা নিজেই জানিয়েছেন ফাতেমা। আশঙ্কাজনক অবস্থায় ওই হাসপাতালে চারদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে হার মেনেছেন তিনি। মঙ্গলবার (২১ মার্চ) সকালে এই গৃহকর্মী চলে যান না ফেরার দেশে।

ফাতেমা চিকিৎসাধীন অবস্থাতেই তার ওপর চলা নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন পরিবারের সদস্যের কাছে। তার সেই বক্তব্য রেকর্ড করে রাখেন তার পরিবারের সদস্যরা।

ওই বক্তব্যে ফাতেমা জানান, গত বৃহস্পতিবার (১৬ মার্চ) সকালে তিনি কাপড় ধুতে গেলে দুটি কাপড়ে রঙ লেগে যায়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে গৃহকর্তা দেলোয়ার ও তার ছেলে আশিক তাকে (ফাতেমা) মারধর করে। পরে গৃহকর্ত্রী সালমা তার শরীরে ফুটন্ত গরম পানি ছুড়ে দেয়। এতে তার শরীরে ফোস্কা পড়ে যায়। দগ্ধ অবস্থায় আর্ত চিৎকার করতে থাকেন তিনি। কিন্তু, তাকে দ্রুত হাসপাতালে না নিয়ে ঘটনাটি আড়াল করার জন্য গৃহকর্ত্রী ও অন্যরা তাকে জোর করে বাথরুমে আটকে রাখে। এরপর কেরোসিন এনে তার গায়ে ঢেলে দিয়ে দিয়াশলাই ঠুকে দেয়। ফুটন্ত পানিতে দগ্ধ হওয়ার পর কেরোসিনের আগুনে আরও মারাত্মকভাবে দগ্ধ হন তিনি। ফাতেমা বলেন, ‘এরপর বাড়ির লোকজন বলতে শুরু করে, বাথরুমে ঢুকে আমি (ফাতেমা) নাকি নিজেই গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়েছি।’

ফাতেমা বলেন, ‘এমন অবস্থাতেও তারা ঢাকায় আমার কোনও চিকিৎসা করায়নি। ওই দিন সন্ধ্যায় তারা প্রাইভেট কারে আমাকে ঢাকা থেকে নিয়ে এসে খুলনা মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতালে ভর্তি করে।’

ফাতেমার ছোট ভাই ইউনুছ সরদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গৃহকর্ত্রী সালমা আমাকে ফোন করে জানান যে ফাতেমার গায়ে আগুন লেগেছে। তাকে নিতে যাওয়ার কথা বলেন সালমা। কিন্তু আমাদের কোনও খোঁজ দেননি তারা। পরের দিন সালমা জানান, ফাতেমাকে খুলনা মেডিক্যাল কলেজে আনা হয়েছে। হাসপাতালে গিয়ে আমার দগ্ধ বোনকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পাইনি।’

এরও দু’দিন পর মঙ্গলবার সকালে ফাতেমা হাসপাতালে মারা যান। সেখান থেকে তার মরদেহ মংলায় আনার পর পুলিশ ময়নাতদন্তের জন্য বাগেরহাট মর্গে পাঠিয়েছে।

মৃত্যুর আগে হাসপাতালে স্বজনদের কাছে ফাতেমার দেওয়া নির্যাতনের বর্ণনা স্বজনরা মোবাইলে ভিডিও করে রেখেছেন। এসময় কান্না জড়িত কণ্ঠে ফাতেমা তাকে বাঁচানোর জন্য আঁকুতি জানাতে থাকে। তাকে ‘আগুন’ ‘আগুন’ বলে কাঁদতে দেখা যায়। মোবাইল ফোনে তার বক্তব্যটি ধারণ করে রাখেন পরিবারের এক সদস্য। সেই ভিডিওটি দেখে কাঁদছেন ফতেমার স্বজন ও এলাকাবাসীরা। এর একটি ভিডিও ফুটেজ বাংলা ট্রিবিউনের হাতে পৌঁছেছে। কিন্তু, ওই ভিডিওতে দগ্ধ ফাতেমার চেহারাটি প্রকাশযোগ্য না হওয়ায় ভিডিওর পরিবর্তে ফাতেমার বক্তব্যটি অডিও আকারে নিচে যুক্ত করা হলো।

নিহত ফাতেমার বড় বোন অরুনা বেগম বলেন, ‘যে বাড়িতে ফাতেমা কাজ করছিল, ওই বাড়ির গৃহকর্ত্রী আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। ভালো কাজ ও বেতনের লোভ দেখিয়ে ফাতেমাকে নিয়ে গিয়েছিল ওরা। কিন্তু কাজ করিয়ে নিত পেটে-ভাতে। এই নির্মম নির্যাতনের বিচার চাই আমরা।’

এ বিষয়ে মংলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. লুৎফুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুলিশ খবর পেয়ে নিহত ফাতেমার বাড়িতে গিয়ে প্রাথমিকভাবে ঘটনার অনুসন্ধান করেছে। পরে লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তে জন্য বাগেরহাট মর্গে পাঠানো হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে ফাতেমাকে নির্যাতন করে আগুনে পুড়িয়ে দগ্ধ করার প্রমাণ মিলেছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে অবহিত করাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

বিষয়টি সম্পর্কে এখনও জানতে পারেনি সংশ্লিষ্ট ঢাকার দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ থানা। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ থানার ওসি (তদন্ত) আবু সাঈদ আল মামুন জানান, ‘এ ব্যাপারে আমাদের কাছে এখনও কেউ অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’

#সংবাদটি বাংলা ট্রিবিউন থেকে নেওয়া

Next Post

মৃত জন - জিনিয়া রহমান

টের পাই আমার ভেতরেও মৃত এক জনের বাস কিছুতেই যার কিছু যায় আসে না। সে হাসে, কথা বলে কিন্তু তার দৃষ্টি আটকে থাকে ঘরের কোণে। সে খেলে, সে দৌড়ায় কিন্তু তার ভাবনা অন্য কোথাও। সে যেতে চায়, যেখানে আর যাওয়া যায় না। সে শুধু মৃত হয়ে পড়ে থাকে। জিনিয়া রহমান