ছোটগল্প: সহযাত্রী // দিব্যেন্দু দ্বীপ

follow-upnews
0 0
ঢাকা থেকে আমি সাধারণত রাতের বাসে উঠি না। রাতের ভ্রমণে অনেক কষ্ট হয়, কিন্তু মাঝে মাঝে বাধ্য হয়ে রাতে জার্নি করাই লাগে। সায়েদাবাদ থেকে রাত বারোটায় মোংলার একটি বাসে উঠেছি। বাস ছেড়েছে আরও পনেরো মিনিট পরে। এত রাতে বাসে একা নারী যাত্রী থাকার কথা নয়, কিন্তু আমার পাশে বসেছে বিশ একুশ বছরের একটি মেয়ে। এমন দিন পড়েছে, এবং পুরুষের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ যে, মেয়েদের পাশে বসা বর্তমানে খুব কঠিন। অত্যন্ত সাবধানে বসতে হয়, তাতে ভ্রমণের মজাটাই নষ্ট হয়ে যায় আসলে। আমি যতটা সম্ভব জানালা ঘেষে বসেছি, তারপরও মেয়েটির শরীরের সাথে সামান্য স্পর্শ টের পাচ্ছি। ও বয়সে আমার চেয়ে ষোলো সতেরো বছরের ছোট হলেও ব্যাসার্ধে বেশ বড়। ফলে বাসের ঝাঁকুনিতে আমার যথেষ্ট সাবধানতা ওর স্বাভাবিকতার কাছে পরাজিত হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।
মাকে হাসপাতালে রেখে ফিরছি, খুব ক্লান্ত ছিলাম। মাঝখানে আমি বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ফেরিতে গাড়ি ওঠার সময় ঘুম ভেঙ্গেছে। মেয়েটি জেগে আছে। সহযাত্রী হলেও কেউই আমরা কারও সাথে এতক্ষণ কথা বলিনি। আমি কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলাম। ভাবলাম, কী দরকার?
তখন প্রায় রাত দু’টো বাজে, ফেরিতে গাড়ি ওঠার পরে ফেরির তিন তলায় গেলাম চা খেতে। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম, মেয়েটাও আমার পিছন পিছন গিয়ে পাশে বসেছে। মধ্যরাত বলে সম্ভবত ভয় পাচ্ছে। আমাকে হয়ত ওর কোনো কারণে বিশ্বস্ত মনে হয়েছে। আমি ওকে চা অফার করলাম। ও মাথা নেড়ে না করলো, আমি আর কিছু বললাম না। ফেরির পথটুকু ও আমার পাশে ভূতের মতো বসেই থাকলো। আমিও ওর কারনে এদিক ওদিক করতে পারলাম না, ঐ এক জায়গায় বসে থাকলাম। নারীর এই এক অদম্য শক্তি, কোনো কথা না বলেও আমাকে অনড় বসিয়ে রেখেছে এক ঘণ্টা। কাছে দূরে অনেকেই ভাত, কেউ রুটি, মাছ মাংস খাচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে পোড়া তেলে ভাজা মাছ, লালটুকটুকে ঝোল- ঘ্রাণেই আমার গ্যাস্ট্রিকে পেট ভরে উঠছে। বাঙালি ক্ষুধা লাগলে খাবারের মান নিয়ে বিশেষ ভাবে না। এদিক থেকে উঁচু নিচুর তেমন কোনো প্রভেদ নেই। পকেটে দুইশো টাকা থাকলে দেড়শো টাকা খেয়ে ফেলা এদেশের অনেক রিক্সালারও স্বভাব। এজন্য বাংলাদেশের বাজার অর্থনীতি বোধহয় খুব চাঙা থাকে।
ফেরি ঘাটে ভিড়েছে, আমরা আবার যে যার সিটে গিয়ে বসলাম। কারো মুখে কোনো কথা নেই। শেষ রাতে আমার চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে এসেছে। তারপরও ঘুমাচ্ছি না, মেয়েটির প্রতি এক ধরনের পুরুষসুলভ আগ্রহ তৈরি হয়েছে হঠাৎ। মাঝে মাঝে আড়চোখে ওকে দেখছি। ও কানে হেড ফোন লাগিয়ে সিট কাঁত করে শুইয়ে আছে, ঘুম কিনা বোঝা যাচ্ছে না। অবয়ব দেখে অবশ্য ঘুম মনে হচ্ছে না। আমিও মি. বিনের মতো ব্যাগ থেকে হেড ফোন কানে দিয়ে চিৎ হয়ে ঘুমের মতো করে শুয়ে থাকলাম। শেষ রাতে অন্ধকার পথে চলন্ত বাসে অচেনা যুবতীর পাশে ‘শুয়ে’ রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনতে যে এত ভালো লাগতে পারে- এ যেন স্বপ্নের অতীত।
বর্ষণমন্দ্রিত অন্ধকারে এসেছি তোমারি এ দ্বারে
পথিকেরে লহো ডাকি তব মন্দিরের এক ধারে
বর্ষণমন্দ্রিত অন্ধকারে এসেছি
বনপথ হতে সুন্দরী
এনেছি মল্লিকামঞ্জলী
তুমি লবে নিজ বেণীবন্ধে
মনে রেখেছি এ দুরাশারে
বর্ষণমন্দ্রিত অন্ধকারে এসেছি
কোনো কথা নাহি বলে ধীরে ধীরে ফিরে যাব চলে
ঝিল্লিঝঙ্কৃত নিশীথে পথে যেতে বাঁশরিতে
শেষ গান পাঠাব তোমা পানে শেষ উপহারে
বর্ষণমন্দ্রিত অন্ধকারে এসেছি
                                                                                — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সত্যিই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, টিপ টিপ বৃষ্টিও পড়ছে। সাথে এই গান, ক’জন সইতে পারে? ইচ্ছে করছে হেডফোনটা অচেনা যুবতীর সাথে ভাগ করে নিয়ে একসাথে শুনি। এসব ঘোরলাগা ভাবনা, মানবীক, কখনো কখনো আমার ক্ষেত্রে তা কিছুটা আধ্যাত্মিকতাও পেয়ে বসে। মনে হয় এই জগতে আমি আর নেই, উড়াল দিয়েছি হঠাৎ হওয়া কোনো প্রিয়জনকে সাথে নিয়ে আকাশের এক কোণে আবছায়া হয়ে।
পথটুকু মনে হলো যেন খুব দ্রুত শেষ হয়ে গেলো। আমি যাব খুলনায়, বাস যাবে মোংলায়। ফলে আমাকে কাটাখালি নামতে হবে। কাটাখালির আগের স্টপেজ নওয়াপাড়াতেই প্রায় সব যাত্রী নেমে গিয়েছে। বাকীরা নেমে যাচ্ছে কাটাখালি, আমিও কাটাখালি নামব। নামার উপক্রম হয়েছি মাত্র, হঠাৎ যুবতী আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, আঙ্কেল, আমার সাথে মোংলা পর্যন্ত যেতে পারবেন? আমার কেমন জানি ভয় ভয় লাগছে। আঙ্কেল বলাতে একটু ধাক্কা খেয়েছি, তবে মোংলা পর্যন্ত যাব কিনা সেটিই তৎক্ষণাৎ বেশি ভাবছি। কোনো কথা না বলে সিটে বসে পড়লাম। নিজেকেই প্রশ্ন করলাম- তার মানে আমি এই অচেনা যুবতীর সাথে মোংলা যাচ্ছি? কেন যাচ্ছি? সে একা যেতে ভয় পাচ্ছে, এজন্য?
আবার নিজের কাছে প্রশ্ন করে নিশ্চিত হতে চাইলাম- কেন যাচ্ছি? এবার আর কোনো উত্তর পেলাম না। হঠাৎ যুবতীর প্রশ্নে ঘোর কাটলো। আঙ্কেল আপনার বাড়ী কোথায়? খুলনায়। তোমার বাড়ী কোথায়? আমাদের বাড়ি মোংলার বানিশান্তা ইউনিয়নের ঢাংমারি গ্রামে। আমার কি এখন অতদূর যেতে হবে? না আঙ্কেল, আপনি আমাকে কাইন্ডলি মোংলা পর্যন্ত পৌঁছে দিন।
গাড়ী মোংলায় পৌঁছানোর পর আমার ইচ্ছে করছে ওর সঙ্গে আরো যাই। তখনও খুব একটা আলো ফোঁটেনি। মোংলা ঘাটে দুই একটি চায়ের দোকানে শ্রমিক শ্রেণির মানুষের আনাগোণা দেখা যাচ্ছে। আমি কথা বাড়ানোর জন্য ওকে বললাম, তুমি এত রাতে কেন আসতে গেলে? আঙ্কেল, আমার মা খুব অসুস্থ। বাড়ীতে ওনাকে দেখার কেউ নেই। এজন্য রাতারাতি আসতে হলো। তুমি কি ঢাকায় পড়াশুনা করো। জ্বী আঙ্কেল, আমি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজ বিজ্ঞানে তৃতীয় সেমিস্টারে পড়ি। ও কী বুঝলো জানি না, হঠাৎ করে আমাকে প্রশ্ন করলো, আঙ্কেল, আপনার কি খুব ব্যস্ততা আছে? যদি ফ্রি থাকেন, তাহলে আমাদের ওদিকটা হতে ঘুরে আসতে পারেন। সুন্দরবনের সাথে আমাদের গ্রাম, গেলে আপনার ভালো লাগবে। তাছাড়া ওখানে ‘গোলকানন’ নামে একটা রিসোর্ট আছে, চাইলে আপনি থাকতেও পারবেন। কিছু ভাইয়েরা ওখানে নতুন একটি রিসোর্ট বানাচ্ছে। নাম দিয়েছে ‘ইরাবতী রিসার্চ সেন্টার’। আমরা মা ট্যুরিস্টদের জন্য বাসায় খাবার রান্না করে পাঠায়। আমাদের বাড়িটা রিসোর্টের একেবারে সাথে বলতে গেলে। যাবেন?
আমি তো মনে মনে এক পায়ে রাজি। তারপরও একটু ভাব নিতে বললাম, এখনো তো রাত ফোটেনি, তোমার সাথে যাওয়াই উচিৎ। তাছাড়া আজ তো শুক্রবার, আমার তেমন কোনো কাজও নেই। আঙ্কেল, বাসায় আপনার কে কে আছে? মা আছেন, আর একটা ছোট বোন আছে। কেন আন্টি নেই? তোমার আন্টি আর আমার বাচ্চা আমেরিকা থাকে। আমার যে সদ্য বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে, এটা আর ওকে বললাম না। বারে বারে আঙ্কেল বলাতে বেশ বিরক্ত হচ্ছি, সে বিরক্তি আবার ভুলে যাচ্ছি ওর স্বতস্ফুর্ত কথাবার্তায়।
এত সকালে ঘাটে যাত্রী নেই। শুধু আমাদের নিয়েই ট্রলার ছাড়তে হবে। ও আগে থেকেই আমাকে বলে রেখেছে যে, ট্রলার আপনার কাছে দেড় দুই হাজার দাবী করবে, কিন্তু আপনি তিনশো টাকা বলে চুপ করে থাকলেই ওরা রাজি হয়ে যাবে। সেভাবেই একটি ট্রলার ঠিক হলো। তার আগে টং দোকানে চা খেয়ে আমরা কিছু কালক্ষেপণ করেছি। এখন বেশ ফর্সা হয়েছে। অবশ্য নদীতে পনেরো বিশ মিনিট আগেই সূর্য ওঠে। ট্রলারের ছাদে দু’জনে মুখোমুখি বসেছি। এই প্রথম ওকে ভালোভাবে দেখলাম। খুব মিষ্টি একটা মেয়ে। কপালে কেনো আঙ্গুলের মাথার সাইজের একটা লাল টিপ পরেছে, সাত সকালের সূর্যের রশ্মিতে ভ্রমণক্লান্ত মুখে টিপটা জ্বলজ্বল করছে। ও অন্যদিকে তাকিয়ে আছে, সুযোগে আমি একটু বেশি করে দেখছি। টিপ পরাতে ভাবলাম ও বোধহয় হিন্দু, না হলে এই ডামাডোলে টিপ পরার কথা নয়, অন্তত রাতে ভয় পাবার কথা। সমাজটা তো দিন দিন ভুতুড়ে হয়ে গিয়েছে। টিপ পরা নিয়ে এই যা হচ্ছে, তাতে সমাজ পিছাচ্ছে বৈ এগোচ্ছে না। মেয়েরা এখন টিপ পরতে ভয় পাবে। এরকম সাহসী হলেই কেবল গড়াপেটায় সমাজটা বদলাবে, নতুবা নয়। আমি ওরা নাম জিজ্ঞেস করলাম। বলল, তাবাসসুম। আমার নামও বললাম। ও বলল, তারিকুল আমার এক কাজিনের নাম। হঠাৎ ও কেমন যেন কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না। নদীর দিকে তাকিয়ে আছে চুপচাপ। আমিও চুপ করে থাকলাম।
আধাঘণ্টার মধ্যে ট্রলার বানিশান্তা ঘাটে পৌঁছুলো। আমি ভাড়া দিতে গেলে ও কিছুতেই দিতে দিলো না। আপনি আমার সাথে এ পর্যন্ত এসেছেন, এটাই অনেক, আবার ভাড়াটাও কেন দিবেন? বললাম, তুমি তো আয় করো না। তাই বলে আমার খরচ আপনি চালাবেন নাকি? ওর কথায় বেশ ধাক্কা খেলাম। মানি ব্যাগটা পকেটে ঢুকিয়ে ওর আগেই রাস্তায় উঠে গেলাম। ওর জন্য অপেক্ষা না করে দোকান থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধরালাম। ও বোধহয় একটু বিব্রত বোধ করছে। বেশ কাচুমাচু হয়ে বলল, আঙ্কেল যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে আমাদের বাড়িতে একবেলা আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। আমার মা খুব ভালো রান্না করেন, কিন্তু উনি যেহেতু অসুস্থ, আমার মন্দ রান্নাই না হয়ে খেলেন। আপনার জন্য গোল কাননে একদিন থাকার ব্যবস্থা করতে পারব। পাশে ‘ইরাবতী’ নামে যে রিসোর্টটা হচ্ছে সেটিও দেখতে পারবেন। সুন্দরবনের যেতে চাইলে ওখানে এক দাদা আছেন, নৌকায় করে আপনাকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবেন।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না- আমি কি তোমাকে নিরাপদে পৌঁছে দিতে এসেছি, নাকি তোমার সাথে ঘুরতে এসেছি? আঙ্কেল, আমি চাচ্ছি- আপনার সময়টা কাজে লাগুক। যেহেতু এতদূর এসেছেন, জায়গাটা একটু ঘুরে গেলেন।
কথা আর বাড়ালাম না, ওর সাথে ভ্যানে উঠে পড়লাম। অটো ভ্যানে একজন পঁচিশ টাকা ভাড়া, তার মানে ওখান থেকে ঢাংমারি গ্রাম বেশ দূরে। তোমাদের এদিকটা দেখছি বেশ সুন্দর। এজন্যই তো আপনাকে আসতে বলেছি। এখন আর ও বারে বারে আঙ্কেল বলছে না। শুধু ‘আপনি’ ‘আপনি’ করে কথা বলছে। বেলাও উঠেছে, আবার নিজের এলাকায় এসে মনোবল ফিরে পেয়েছে। ও কার সাথে যেন ফোনে কথা বলে আমার জন্য গোলকাননে একটা রুম ঠিক করলো। সারাপথ আর তেমন কথা হলো না। ওর মাকে একবার ফোন করলো- মা, তুমি কি একটু সুস্থ বোধ করছো? আমি কিন্তু প্রায় চলে এসেছি।
সত্যিই একদম সুন্দরবনের কোল ঘেষে গ্রামটা। ও আমাকে রিসোর্টে রেখে কাছে কোথায় বাড়িতে চলে গেলো। ওখানে অবিনাশ দা আছেন তত্ত্বাবধায়ক, উনিই আমার দেখভাল করছেন। গামছা, লুঙ্গি দিয়ে গোসলের সব ব্যবস্থা করে দিলেন। সকালে নাস্তা এনে খাওয়ালেন। আমি রিসোর্টটা ঘুরে দেখলাম। পাশে নির্মীয়মান রিসোর্টটাও দেখলাম। বেশ ভালো উদ্যোগ। সুন্দরবনের কোল ঘেষে নিরিবিলি কয়েকদিন গ্রাম্য পরিবেশে কাটাতে চাইলে এ এক অসাধারণ জায়গায়। আমি তাবাসসুমের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করলাম।
দুপুর ঘনিয়ে এসেছে, আকাশটা একটু মেঘলা মেঘলা, রোদ এই আছে এই নেই। গোলপাতার ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছি- একটা টিফিন বক্স হাতে ‘ভাতিজি’ আসছে। এসেই আমার হাতে টিফিন বক্সটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, আপনার খাবার। আশ্চর্য! এখন দেখি আর ‘আঙ্কেল’ বলে না, কিছুই বলছে না। ও আর দেরি করলো না। চীনা হাঁসের মতো মৃদুমন্দ গতিতে চলে গেল।
আমি খেয়েদেয়ে রাতজাগা ঘুমে ঘুমিয়ে পড়ব ভাবছি। কিন্তু খাবারগুলো এতটাই চমৎকার যে, কিছুক্ষণ জাবর না কাটলে নয়। হাঁসের মাংস, সুন্দরবনের চিংড়ি, ছোট চিংড়ি দিয়ে মোচার ঘণ্ট, বেগুন ভাজা এবং মুগ ডাল। অনেকদিন এরকম যত্ন করে কেউ খাওয়ায় না। সত্যিই একেবারে ফিদা হয়ে গিয়েছি। মনে হচ্ছে, তাবাসসুমকে ডেকে এখনই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করি। হায়রে! মোবাইল নম্বরটাই তো নেওয়া হয়নি এখনো।
কোন সময় ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। রাতজাগা ঘুম। উঠেছি প্রায় সন্ধ্যা লাগিয়ে। খুলনায় ফিরতে হবে। প্রস্তুত হয়ে নিলাম। রুম থেকে বেরিয়েই দেখি- একটা আটপৌরে শাড়ী পরে মেয়েটা গোলপাতার ফাঁকে ফাঁকে ঘুরছে, মনে হচ্ছে যেন কোনো ফুলপরি জনশূন্য প্রান্তরে একাকী অপেক্ষা করছে কোনো এক রাজকুমার আসবে বলে। ও আমাকে দেখতেই এগিয়ে আসলো। খুব একটা কিছু বলতে পারছে না। শুধু বললো, আঙ্কেল, চলে যাচ্ছেন? যেতে তো হবেই। কালকে অফিশ আছে। এখান থেকে গিয়ে অফিশ ধরা কঠিন হয়ে যাবে। ও হঠাৎ আনমনা হয়ে বলল, আপনাকে একটা কাগজ দিব। বাসায় গিয়ে খুলবেন, পথেও পড়বেন না কিন্তু। বাসায় গিয়েই পড়বেন। আমি ভাবলেশহীনভাবে কাগজটা নিয়ে পকেটে রাখলাম।
আমার বাসায় আসলে কেউ নেই। ওকে বানিয়ে বানিয়ে মা এবং ছোট বোনের কথা বলেছিলাম। দুই রুমের একটি ফ্লাটে একাই থাকি। চাকরি করি, বাসায় ফিরি, বইপত্র পড়ি, দুনিয়ার খবর দেখি- এই এক জীবন মেনে নিয়েছি আমি। খুব কোনো বন্ধু-বান্ধবও এখন আর নেই। ওর দেওয়া কাগজ এখনো খুলে দেখিনি।
কাগজটা খুলতেই আমি হতবাক। এ তো দেখি একটা কবিতা! কবিতা লেখে নাকি ও তাহলে? পড়লাম—
ঘুমের ঘোরে আমার ঘাড়ের ওপর
কয়েকবার গড়িয়ে পড়েছিলেন আপনি,
আমি ভেবেছিলাম-
লোকটা ইচ্ছে করে এমন করছে কিনা,
পরে ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম,
আপনি ওপাশে জানালার কাঁচের ওপরও
মাঝে মাঝে পড়ছেন,
একবার তো মনে হলো ব্যথা পেয়ে ঘুমের মধ্যে
চমকে উঠলেন।
তবু আপনার ঘুম ভাঙলো না!
এতটা ক্লান্ত থাকে মানুষ!
কীসের এতটা ক্লান্তি আপনার?
আমি শুনতে চাই।
বলবেন আমাকে একদিন, কোনোদিন?
এরপর ফেরির মধ্যে এক ঘণ্টা পাশে বসে থাকলাম,
দেখলাম, কোথায় যেন আপনি হারিয়ে থাকেন,
কোন জগতে আপনার বসবাস বলতে পারেন?
আমি জানতে চাই।
বলবেন আমাকে একদিন খুব যত্ন করে?
আমার খুব ইচ্ছে করে
কোনো এক অচেনা পথিকের জীবন ছুঁতে,
আমার খুব ইচ্ছে করে
কোনো এক যাযাবরের একাকীত্বের কতৃত্ব হতে,
আমার যে খুব ইচ্ছে করে? সত্যি ভীষণ ইচ্ছে করে।
Next Post

এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিকথা // দেবেশ চন্দ্র স্যানাল

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর হইতে ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারী পর্যন্ত পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের গণ পরিষদ (জাতীয় পরিষদ) এর ১৬২টি আসনের ১৬০টিতে গণ ভোটে বিজয়ী হয় তৎকালীন বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ আরো ৭টি সংরক্ষিত মহিলা আসনের অধিকারী […]
শাহজাদপুর