বিষয়: সাহায্য/সহযোগিতা

follow-upnews
0 0

সাহায্য এই পৃথিবীর কার না প্রয়োজন হয়? জীবনে সবাই-ই কোনো না কোনোভাবে অন্যের সাহায্য নিয়ে বাঁচে। কিন্তু একান্ত বাধ্য না হলে সরাসরি সাহায্য নিতে কেউ-ই চায় না, সবাই চায় কৌশলে নিতে— প্রাপ্যের খাতায় ফেলে নিতে। এক্ষেত্রে মানুষ একেবারেই সাম্যবাদী নয়— নিজের বেলায় সে চায় কৌশলে বা অপকৌশলে নিতে, কিন্তু দেবার বেলায় আবার সে পরোক্ষ পথ বেছে নেয় না, সরাসরি এবং সাহায্য হিসেবে দিতে চায়।

‘সাহায্য’ না বলে ‘সহযোগিতা’ বললে বোধহয় অনেকের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য হবে, কারণ, ‘সাহায্য’ শব্দটার মধ্যে ‘করুণা’ লুকিয়ে আছে, মানুষ করুণার পাত্র হতে পছন্দ করে না, এতে তার আতে (আত্মায়) ঘা লাগে। ইংরেজিতে শব্দটা ‘হেল্প’ —সুবিধে হচ্ছে এক্ষেত্রে সাহায্য বা সহযোগিতার মতো ভেদাভেদ নেই। আবার সমস্যাও কিছু আছে— ‘হেল্প’ শব্দটা স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, যেমন, ‘হেল্প’-এর সাথে ‘ফাইনানশিয়াল’ যোগ না করলে সেটি কোন ধরনের ‘হেল্প’ তা পরিষ্কার হয় না, অপরদিকে ‘সাহায্য’ বললে বোঝা যায় যে, এটি আর্থিক বিষয়, ‘সহযোগিতা’ বললে তা আবার ভিন্ন কিছুও হতে পারে।

এসব শব্দের সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম বিশ্লেষণ, জীবন পরিচালনার জন্য খুব জরুরী নয়, জরুরী না হলেও প্রায়োগিক দিকটা মানুষ ঠিকই বোঝে। আপনি যদি কাউকে বলেন, “তোমাকে আমি সাহায্য করতে চাই।” এটা সে ভালোভাবে নাও নিতে পারে, কিন্তু যদি বলেন, “তোমাকে আমি সহযোগিতা করতে চাই।” তাহলে সে কষ্ট নাও পেতে পারে, যদিও অর্থ একই থাকছে। এটাই শব্দের শক্তি এবং ভেদাভেদ।  

সমাজে বিভিন্ন ধরনের সাহায্য/সহযোগিতার বিষয় থাকলেও মোটা দাগে বিষয়টিকে আমি দুইভাগে ভাগ করতে চাই— (১) টাইম বাউন্ড হেল্প; (২) ফাইনানশিয়াল হেল্প। সময় দিয়ে মানুষকে হেল্প করা যায়, অথবা হেল্প করা যায় টাকা দিয়ে। বলবেন যে, সুপরামর্শ দিয়েও তো মানুষকে হেল্প করা যায়, যায় বটে, সেটিও ঐ ‘টাইম বাউন্ড হেল্প’-এর মধ্যেই পড়ে। কাউকে বুঝতে হলে তার সাথে ওঠাবসা করা লাগে, তার সম্পর্কে জানা লাগে —এটা সময় দেওয়ার প্রশ্ন, কারো সম্পর্কে ঠিক মতো না জেনে তাকে আপনি সুপরামর্শ দিবেন কীভাবে? আপনার মতো করে আপনি পরামর্শ দিলে তো হবে না, হবে কি? মাছকে যদি পাখি হয়ে উড়তে বলেন, সেটি কি আসলে সুপরামর্শ দেওয়া হয়?

মানুষ আসলে কাকে হেল্প করতে চায়? বন্ধুকে? আত্মীয়-স্বজনকে? প্রতিবেশীকে? দুস্থ-পীড়িতকে? সবাইকেই মানুষ হেল্প করতে চায়, কিন্তু এর মধ্যে রকমফের আছে। দুস্থ-পীড়িতকে হেল্প করতে চাওয়াটা মানুষের জন্য সহজ, কারণ, এই হেল্প করার মধ্যে ব্যক্তির ঝুঁকি নেই, পীড়িত বা নিঃস্ব মানুষটি তাকে কখনো ছাড়িয়ে যেতে পারবে না। কিন্তু বন্ধুকে, আত্মীয় বা প্রতিবেশীকে হেল্প করার ব্যাপারে মানুষের ভয় থাকে, লুকায়িত ঈর্ষা থাকে; তাই মানুষ সাধারণত তখনই এই সম্পর্কগুলোর মধ্যে হেল্প করতে চায় যখন কেউ মরণাপন্ন রোগে পড়ে বা  পেটে-ভাতে বিপদে পড়ে, এবং ততটুকুই হেল্প করতে চায় যা দিয়ে সে কোনোরকমে বেঁচে যেতে পারে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, উন্নয়নের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষ এই সম্পর্কগুলোর মধ্যে হেল্প করতে চায় না— সেটি সময় দিয়ে হোক, সুপারিশ করে হোক বা টাকা দিয়ে হোক।    

প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে মানুষ এই সম্পর্কগুলো কীভাবে রক্ষা করে? আসলে এক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষ চতুরতার আশ্রয় নেয়, অনেকে গরীব আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বা গরীব প্রতিবেশী এড়িয়ে চলে যাতে শুধু দিয়ে যেতে না হয়। মানুষ একটা ক্লাস্টার খুঁজে নেয়, যেখানে দেবার ভণিতায় মূলত লেনদেন হয়— যেমন, আমার ছেলের জন্মদিনে আপনি একটা শিয়েল দিলেন, আবার কিছুদিন পর আপনার মেয়ের জন্মদিনে আমি একটা কুকুর দিলাম। নানান ধরনের পারস্পারিক আদিখ্যেতা এবং ন্যাকামো তো আছেই। অনার্থিক বিষয়গুলোও তেমন, আমি আপনার বই শেয়ার দিলাম ফেসবুকে, আপনি আমার বই শেয়ার দিলেন। সুবিধে হলো— নির্লজ্জ্বতা বা স্বার্থপরতা থাকে অন্তর্নীহিত, দেখা যায় না, আধুনিক স্বচ্ছল, শিক্ষিত মানুষের জীবন প্রধানত এই ক্লাস্টারের মধ্যেই পড়ে। 

আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব বা প্রতিবেশীর মধ্যে ‘হেল্প’ বিষয়টি যে একেবারে নেই, তা নয়। তবে এক্ষেত্রে হেল্প নিতে মানুষ ভয় পায়, সঙ্গত কারণেই ভয় পায়। ‘হেল্প’ করে সাহায্যকারী বারো জনকে সদরে না হলেও গোপনে বলে বেড়াবে এই ভয় যেমন পায়, একইসাথে ভয় পায়— আমার হেল্প নিয়েই তো তুমি এতদূরে আসতে পেরেছা, এটা সরাসরি না বললেও সাহায্যকারীর আচরণে তা সুস্পষ্ট থাকে বলে। এর চেয়ে বেশি যেটা হয়— সবসময় সে কৃতজ্ঞতা আশা করে, যার অন্য নাম হচ্ছে ফিডব্যাক বা প্রতিদান। মুখে বলে নিঃস্বার্থ, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রতিদান চাওয়ার ব্যাপারটি দানের মধ্যে সুপ্ত থাকে, এবং সাহায্য গ্রহীতার কোনো কাজে বা আচরণে পানের থেকে চুন খসলেই তা জাগ্রত হয়ে ‍ওঠে নখদন্ত বের করে।   

কিছু সম্পর্ক আছে যেখানে ঐ ঈর্ষা বা ছাড়িয়ে যাওয়ার ভয়টি নেই, কিন্তু সেখানে আছে আনুগত্যের প্রশ্ন, একই ধরনের বিশ্বাস এবং পছন্দ অপছন্দের প্রশ্ন— অর্থাৎ যতখানি অনুগত হলে এবং চাইতে থাকলে হেল্প মিলবে ততখানি অনুগত আপনি হতে পারবেন না, ফেউ হয়ে পিছে লেগে থাকতে পারবেন না। আপনার অবস্থা বুঝে হেল্প করার চেষ্টা করবে এমন বস, দিদি, আপা, বড় ভাই বা উচ্চতর কাউকে কি আপনি খুঁজে পেয়েছেন কখনো? পেয়ে থাকলে আপনি ভাগ্যবান।   

সাহায্য বা সহযোগিতা শব্দটিকে ঘিরে ভালো ভালো বা মহানুভব যত কথা তা হচ্ছে ঐ দুস্থ-পীড়িত মানুষকে ঘিরে —যাদের পেটে ভাতে বাঁচিয়ে রাখা হবে, কিন্তু কখনই তারা কেউ সমাজের হর্তাকর্তা হবে না। এদের নিয়েই হৈচৈ, ত্রাণ, দান ধ্যান ইত্যাদি। অথচ এই মানুষগুলোর মধ্যে অধিকাংশ হয়ত এই স্টেজটা পার করে এসেছে যাদের হেল্প পাওয়ার কথা ছিল বন্ধু, প্রতিবেশী বা আত্মীয়দের কাছ থেকে, শুরুতে তাকে হেল্প করা হলে সে হয়ত এই অবস্থার মধ্যে পড়তই না।

আবার অনেকে তো হেল্প করে পূণ্য অর্জন করতে চায়, যা দিয়ে সে ভবতরী পার হবে! এমন সংখ্যাও কম নয়, কোনো গবেষণা আছে কিনা জানি না— তবে সমাজে দুঃস্থরা যে চুইয়ে পড়া অংশটুকু চেটেপুটে খেয়ে বেঁচে থাকে তার অধিকাংশটুকুই হয়ত ঐ পূণ্যলোভী মানুষের দানধ্যানের ফসল। সামগ্রিকভাবে, নিঃস্বার্থভাবে— মানুষকে সম্মানজনক স্থানে ধরে রাখার জন্য, যোগ্যতর মানুষকে পথ করে দেওয়ার জন্য এবং সমাজ-সভ্যতার স্বার্থে মানুষ কতটুকু এগিয়ে আসে সে বিষয়ে বিস্তর সন্দেহ রয়েছে। 

তাই বলে কিছু মানুষ যে সমাজে নেই তা নয় যারা যোগ্যকে যোগ্য করে তুলতে চায়, আপনার চেয়ে যোগ্যতর মানুষটাকে পথ ছেড়ে দিতে চায় —এরকম মানুষ আছে, তবে খুবই কম, এবং নিঃসন্দেহে এ যুগে বিরল। সেরকম দুএকজন বুন্ধ বা আত্মীয় যদি আপনার থেকে থাকে তাহলে নিজেকে খুব ভাগ্যবান ভাবতে পারেন।

ভালো কথাগুলোও একটু স্মরণ করা উচিৎ যাতে মানুষের বোধদয় হয়, মানুষ সত্যিকারঅর্থে মানুষের পাশে দাঁড়াতে চায়, এবং সে পাশে দাঁড়ানো শুধু যেন এমন না হয় যারা ইতোমধ্যে পতিত হয়েছে, বরং হেল্প করা উচিৎ মানুষ যাতে পতিত না হয় সেজন্য। ভালো কথা হিসেবে চার্লস ডিকেন্সের লাইনটিই স্মরণ করি— “কেউই এই পৃথিবীতে নিস্ফল নয়, যদি সে অন্যের ভার লাঘব করে।” পাবলো পিকাসো চমৎকার বলেছেন, “জীবনের অর্থ নিহীত রয়েছে কিছু অর্জন করার মধ্যে, আর জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে তা বিলিয়ে দেওয়া।” তাই কি করি আসলে আমরা? বরং তুলনামূলক ব্যর্থতাগুলো ভার হিসেবে ঘাড়ে চাপিয়ে মাথা কুটে মরি। আয়-ব্যয়, ভাব-ভণিতা আর কেনাকাটাময় এ জীবনে অন্যের পাশে দাঁড়ানোর সময় খুব কম মানুষই পায় আসলে। যারা পায় নিঃসন্দেহে তারা সৌভাগ্যবান।

Next Post

বিষন্ন রোববার // শাহিদা সুলতানা

যতটুকু দেবে বলে ভেবেছিল সেই প্রসন্ন প্রহর, ততটুকু পেয়ে গেছি, তাই আজ আবার এসেছি ফিরে আমার পুরনো বিষন্ন শহরে— পুরনো বিষন্ন বাড়ি এখনো তেমনি রয়েছে দাঁড়িয়ে একলা হয়তো আমারই অপেক্ষায়। জানালার কার্নিশে এখন রয়েছে বসে সেই বোবা কবুতর, ছাদের দড়িতে এখনো ঝুলে আছে ফেলে যাওয়া শীতের মাফলার। সোম থেকে শনির […]
Shahida Sultana