শেকসপিয়রের দ্ব্যার্থবোধক বিশ্বাস এবং অন্তর্নিহীত বিজ্ঞানমনস্কতা

follow-upnews
0 0
অনেকে বলে শেকসপিয়র (১৫৬৪ – ১৬১৬) বিজ্ঞানমনস্ক না, এটা একেবারে ভুল কথা। তিনি আপাতভাবে চার্চের প্রতি অনুগত থেকে সাহিত্য চর্চা করেছেন ঠিকই, কিন্তু তার সাহিত্য সে সাক্ষ্য দেয় না যে, তিনি তার সাহিত্যে অন্ধ বিশ্বাস বা বিচার বুদ্ধিহীনভাবে স্বর্গের জয়গান গেয়েছেন। বরং সর্বত্র তিনি জীবনকেই বড় করে দেখেছেন, তবে তা তিনি করেছেন মানুষ সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে।
এই বাক্যটি পড়ুন— the paragon of animals! অর্থাৎ তিনি মানুষকে বলেছেন, ‘পারফেক্ট এনিম্যাল’। এই লাইনটির মধ্যে যতটুকু বিজ্ঞান আছে, ততটুকু বিজ্ঞানমনস্কতা কি একালের লেখকদের মধ্যে আছে? 
এবার পুরো প্যারাটি (মনোলগ) পড়ুন— “What a piece of work is a man! How noble in reason! how infinite in faculty! in form, in moving, how express and admirable! in action how like an angel! in apprehension how like a god! the beauty of the world! the paragon of animals! And yet, to me, what is this quintessence of dust?”
তিনি বলেছেন, in apprehension how like a god! এখন ‘এপ্রিহেনসন’ শব্দটিকে যদি আপনি ‘বোধবুদ্ধি’ হিসেবে বাংলা করেন, তাহলে তিনি মানুষকে ঈশ্বর (ঈশ্বরের মতো বলেছেন, সরাসরি ঈশ্বর বলার সুযোগ তখন ছিল না) বলেছেন।
শেষ লাইন এসে তিনি হতাশা ব্যক্ত করেছেন, যে হতাশাবাদের মধ্যেও রয়েছে বিজ্ঞান। তিনি মানুষকে বলতে চেয়েছেন, quintessence of dust, ‘quintessence’ অর্থ যদি করেন জিনিসের ‘পরিশ্রুত’ অংশ, তাহলে তিনি মানুষকে আবার বলেছেন, ‘মৃত্তিকার পরিশ্রুত অংশ’।
এই লাইনে এসে হাতাশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে, বলা হয়েছে— নোবেলিটি, ইনফাইনিটি, এঞ্জেলিক, গডলি হওয়ার পরেও হ্যামলটে নাটকে হ্যামলেট হাতশার সুরে বলছেন, “তবুও বলি, এত গুণে সমৃদ্ধ এই মানুষ দিয়ে আমি কী করব”? Despite the nobility, the reason, the grace, and the beauty of man, Hamlet (Shakespeare) cannot be delighted.
শেকসপিয়রের জন্ম ডারউইনের জন্মের ২৪৫ বছর আগে। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার তখন কেবল শুরু হয়েছে। বিবর্তনবাদের প্রশ্নই আসে না। ইউরোপজুড়ে তখন চার্চের জয়জয়কার। জিওর্দানো ব্রুনো (১৫৪৮ – ১৬০০) শেকসপিয়রের সমসাময়ীক, মনে রাখতে হবে যে, ব্রুরোকে চার্চ পুড়িয়ে মেরেছিল, কারণ, তিনি মতবাদ প্রচার করেছিলেন যে, মহাবিশ্ব অসীম এবং এর কোনো কেন্দ্র নেই। আর এজন্য প্রচলিত ধর্মের বিরোধিতার (heresy) অপরাধে তাকে পুড়িয়ে মারা হয়।
এরকম একটা সময়ের ওপর দাঁড়িয়ে শেকসপিয়র যতটা বিজ্ঞান মনস্কতার পরিচয় দিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় এবং যথেষ্ট— কিন্তু শেকসপিয়রের ভাষ্যগুলো অন্তর্নিহীত, সরাসরি বলার সুযোগ তখন ছিল না। আবার তিনি কোনো প্রবন্ধও লেখেননি যে সরাসরি বলবেন।
যেমন, জুলিয়াস সিজার নাটকে ক্যাসিয়াসের ভাষ্যে শেকসপিয়র লেখেন, “Men at some time are masters of their fates; the fault, dear Brutus, is not in our stars, but in ourselves, that we are underlings.” বলে দিচ্ছেন যে, আকাশের তারারে মধ্যে কিছু লেখা নেই, সবই মানুষের কর্মফল। এর চেয়ে বেশি আর কী লিখবেন? কীভাবে লিখবেন?
শেকসপিয়র তার সমসাময়ীক মেধাবী লেখক ক্রিস্টোফার মারলোর (১৫৬৪ – ১৫৯৩) মতো বিপ্লবী ছিলেন না, শেকসপিয়র টিকে থাকতে চেয়েছিলেন, টিকে থাকতে চেয়েছিলেন বলেই শেকসপিয়রকে বিপ্লবীরা মানতে পারেন না, এবং এই না মানাটা তাকে স্টাডি না করেই।
যদিও একই বয়সী, তারপরও এটা বলা হয় যে শেকসপিয়র মার্লোর লেখা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। মার্লোর রহস্যময় অকালমৃত্যুর পর শেকসপিয়র এলিজাবেথীয় থিয়েটারে তার আসনটি গ্রহণ করেন। ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে মার্লোকে হত্যা করা হয়েছিল বলে জানা যায়।
শেকসপিয়র কোথাও ঈশ্বর সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু বলেননি। যা বলেছেন তার কোনো সুনির্দিষ্ট অর্থ দাঁড় করানোটাও বোকামী। এক্ষেত্রে এসে শেকসপিয়র সবসময় বৈপরিত্য এবং অস্পষ্টতার আশ্রয় নিয়েছেন— যেমন, “Ignorance is the curse of God; knowledge is the wing wherewith we fly to heaven.” লাইনটিকে ঈশ্বর বিশ্বাসের পক্ষেও ব্যাখ্যা করা যায় আবার বিপক্ষেও ব্যাখ্যা করা যায়। আবার ঈশ্বর বা স্বর্গকে তিনি কৌশলে খারিজও করেছেন— বলেছেন,  “Our remedies oft in ourselves do lie, Which we ascribe to Heaven.” অর্থাৎ আমাদের সমস্যার সমাধান আমরাই করতে পারি, যেগুলো পারি না, সেগুলোকে ঈশ্বরের ওপর চাপাই। ‘When beggars die there are no comets seen; The heavens themselves blaze forth the death of princes’ অর্থাৎ যখন একজন ভিক্ষুক মারা যায় তখন আকাশে কোনো উল্কা দেখা যায় না, কিন্তু স্বর্গ নিজেই জ্বলে ওঠে একজন রাজপুত্রের মৃত্যুকে ঘিরে।
শেকসপিয়র তৎকালীন চার্চের প্রতি অনুগত থেকেই লেখালেখি করেছেন, নাটক পরিচালনা করেছেন। কিন্তু অনেক তাত্ত্বিক তাকে সিক্রেট ক্যাথলিক বলে থাকেন, অনেকে আবার তাকে বলেছেন সিক্রেট এথিস্ট। অনেকে তাকে সেক্যুলার হিউম্যানিস্ট হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। সে যাইহোক না কেন মানব জাতির সামনে উইলিয়াম শেকসপিয়র যে দর্শন (বিশ্লেষণ বলাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত) উন্মুক্ত করেছেন তা অমূল্য।
Next Post

বিষয়: সাহায্য/সহযোগিতা

সাহায্য এই পৃথিবীর কার না প্রয়োজন হয়? জীবনে সবাই-ই কোনো না কোনোভাবে অন্যের সাহায্য নিয়ে বাঁচে। কিন্তু একান্ত বাধ্য না হলে সরাসরি সাহায্য নিতে কেউ-ই চায় না, সবাই চায় কৌশলে নিতে— প্রাপ্যের খাতায় ফেলে নিতে। এক্ষেত্রে মানুষ একেবারেই সাম্যবাদী নয়— নিজের বেলায় সে চায় কৌশলে বা অপকৌশলে নিতে, কিন্তু দেবার […]
সহযোগিতা