এলাকায় (বাধাল ইউনিয়নে) লক্ষণ সাধুর পরিবারটি ছিল তৎকালীন সময়ে সম্ভ্রান্ত একটি পরিবার। এলাকায় তার সুনাম ছিল। স্ত্রীর সম্পদ এবং নিজের সম্পদ মিলিয়ে তার অনেক জায়গা জমিও ছিল। তিনি সুন্দরবনের কাঠুরেদের কাছ থেকে কাঠ এনে দৃষ্টিনন্দন একটি বাড়ী করেছিলেন দেশভাগের পরপর। পরোপকারী হবার কারণে আগে থেকেই এলাকায় তার সুনাম এবং বাড়িটির কারণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন কিছু মানুষের ঈর্ষারপাত্র।
লক্ষণ দাস মারা যান ১৯৫৭ সালে। এর কিছুদিন পরেই তার ছোট সন্তান ভারতে গিয়ে পুলিশে চাকরি নিয়ে ভারতের নাগরিক হন। নিয়ামানুগভাবেই সম্পত্তির মালিক হন লক্ষণ সাধুর বড় সন্তান গৌর হরি দাস। তারপরেও তিনি ভাইকে প্রতি বছর ভারতে টাকা পাঠাতেন, এবং দুই ভাইয়ের মধ্যে সবসময়ই সদ্ভাব ছিল।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে এলাকার অল্প কিছু ঈর্ষাপরায়ণ হিন্দু লোক যেমন চাইছিল পরিবারটির ওপর কোনো অত্যাচার হলে হোক, আবার এলাকার রাজাকারেরাও সুযোগ খুঁজতেছিল পরিবারটিতে লুটপাট চালানোর।
১০ জুন ১৯৭১ সালে আশেপাশের এলাকার রাজাকারেরা এসে গৌরহরি দাসের বাড়িতে ভয়াবহ এক ডাকাতি সংগঠিত করে। ডাকাতির সময় গৌরহরি দাস এবং তার স্ত্রী চপলা রাণীকে মারধর করে। মারধরের এক পর্যায়ে চপলা রাণী দাসের হাত ভেঙে যায়। ডাকাতরা বাড়ির স্বর্ণালঙ্কার এবং টাকা পয়শা নিয়ে যায়। পরের দিন সকালে গৌরহরি দাস স্ত্রীকে নিয়ে বাগেরহাট শহরে যান চিকিৎসা করাতে। তারা আর বাড়িতে ফেরেননি।
পরের দিন আরও রাজাকার লোকজন এসে দিনের বেলায় দুই গোয়াল গরু নিয়ে যায়। একইসাথে হুমকি দিয়ে যায় যাতে সবাই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। গৌরহরি দাসের চার সন্তান তখন বুঝমান। তারা অন্য ভাইবোনদের নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বাগেরহাট গিয়ে শূন্যহাতে ভারত যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
১২ জুন থেকেই বাড়িটিতে রাজাকারেরা ক্যাম্প করে। যেহেতু বাড়িটি বৃহৎ এবং দোতলা ছিল, তাই অনেক রাজাকার সেখানে থাকত, এবং আশেপাশের বাড়িতে লুটপাট চালাত। ৪ নভেম্বর (১৯৭১) তারিখে অদূরে শাঁখারিকাঠী বাজারে রাজাকারেরা যে গণহত্যাটি ঘটায় সেখানে দৈবজ্ঞহাটির ক্যাম্প থেকে এবং গৌরহরি দাসের এই বাড়িটি থেকে রাজাকারেরা অংশগ্রহণ করেছিল বলে জানা যায়।
স্বাধীনতার পরে গৌরহরি দাসের পরিবারের ঘরের একটি খাট পর্যন্ত পাননি। এমনকি চাল থেকে টিনগুলোও খুলে নেওয়া হয়েছিল। এমনই এক পরিস্থিতিতে দশটি সন্তান নিয়ে ভয়ানক এক পরিস্থিতিতে নিপতিত হয়েছিলেন গৌরহরি দাস দম্পতি। যদিও তাদের অনেক সম্পত্তি ছিল, কিন্তু সবকিছু গুছিয়ে নিতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল।
এরপর এলাকার কিছু মানুষ সমাজদরদী এই মানুষটির সততার সুযোগে তার সাথে নানান ধরনের প্রতারণা করে। ১৯৭১ সালের পর ছয়বার বাড়িটিতে ডাকাতি হয়। একবার ডাকাতদের নির্যাতনে গৌরহরি দাস মৃতপ্রায় হয়ে যায়। এভাবে নানাবিধ নির্যাতন সয়ে পরিবারটি যখন একটু থিতু হতে শুরু করেছে, ছেলেমেয়েগুলো সবাই শিক্ষিত হয়েছে, তখনই শুরু হয় ভিন্ন এক ষড়যন্ত্র— ১৯৭৭ সালে ভাইয়ের মেয়ে তঞ্চকতা করে গৌরহরি দাসের অসুস্থ নিরক্ষর মায়ের কাছ থেকে চিকিৎসার কথা বলে নিয়ে গিয়ে তার নামে থাকে সম্পত্তি লিখে নেয়— যেটি গৌরহরি দাস জানতে পরে ১৯৮৬ সালে, যখন এলাকার তৎকালীন বিএনপি’র নামকরা সন্ত্রাসী সুদা মিনা সম্পত্তি দখল করতে আসে।
গৌরহরি দাস সম্পত্তি উদ্ধারে মামলা করেন, কিন্তু ততদিনে মামলা তামাদি হয়ে গিয়েছে এবং বিবাদী গৌরহরি দাসের ভাইঝি নমিতা রাণী দাসও সুদা মিনার কাছ থেকে টাকা নিয়ে মামলার পিছনে ব্যয় করতে শুরু করেন। সুদা মিনা এবং এলাকার অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠী গৌরহরি দাসের বাগান থেকে লক্ষ লক্ষ টাকার গাছ কেটে নিয়ে যায়। এলাকার সমাজকর্মী রামসুন্দর দাস বলেন, কাকার বাগানে যেসব শাল, সেগুন, সিড়িশ গাছ ছিল, অত বড় গাছ অত্র এলাকার কারও বাগানে ছিল না। ওরকম এক একটি গাছের দাম হবে বর্তমানে লক্ষাধিক টাকা। তিনশোর বেশি তালগাছ ছিল, যেগুলোও সন্ত্রাসী বাহিনী কেটে নিয়ে যায়।
এ বিষয়ে প্রয়াত গৌর হরি দাসের স্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা চপলা রাণী দাস বলেন, আমরা ’৭১ সালে রাজাকারদের হাতে এবং এরপর যেভাবে বিএনপি’র সন্ত্রাসীদের হাতে নির্যাতিত হয়েছি, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছি। ’৭১ সালে রাজাকারেরা ডাকাতি করতে এসে আমার স্বামী এবং আমাকে মারধর করে। স্বামীকে উদ্ধার করতে গিয়ে আমার দুটো হাতই ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। আমার হাত থেকে চুরি খুলে নেয়। শাঁখা ভেঙ্গে যায়। সিন্ধুক থেকে সব গহনা বের করে দিতে হয়। স্বাধীনতার পরেও দফায় দফায় আমাদের বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। এরপর তো বিএনপি’র সন্ত্রাসীরা একরকম প্রকাশ্যেই আমাদের সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে গেছে। আমার অনেকগুলো সন্তান। এর মধ্যে তিনজনের মানসিক সমস্যা রয়েছে। মামলা মোকদ্দমা এবং মানসিক সমস্যার কারণে কেউ-ই তেমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। আমি বর্তমানে খুবই দুঃখকষ্টের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছি।