পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গণহত্যা চালানোর সাহস দেখাচ্ছে

follow-upnews
0 0

গণহত্যা নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা ও ধর্ষণের দায়ে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের শাস্তি না হওয়ায় বাংলাদেশে তাদের দোসরদের যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে দেশটি নাক গলানোর মতো ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন একটি আলোচনা সভার বক্তারা।

এমনকি পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় এখন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যেও দেশটির সেনাবাহিনী গণহত্যা চালানোর সাহস দেখিয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন একজন।

ওই আলোচনা সভার বক্তাদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে আন্দোলনকারী এবং একাত্তরের কয়েকজন বিদেশি বন্ধুও ছিলেন।

গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টের আয়োজনে ‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ’ শিরোনামে শনিবার সকালে রাজধানীর বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে এই সেমিনার হয়।

সেমিনারে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। আলোচনায় অংশ নেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী, একাত্তরের বিদেশি বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক টমাস এ ডাইন, ভারতের সাংবাদিক ও লেখক হিরন্ময় কার্লেকার।

গওহর রিজভী বলেন, একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে অনেক অপপ্রচার হয়েছে। পাকিস্তান বারবার তাদের পরিচালিত এ গণহত্যাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছে। কিন্তু সত্য কখনও চাপা থাকে না। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিচালিত গণহত্যা সম্পর্কে বিশ্ববাসী সত্যিটা জেনেছে। এখন আমাদের কাজ হল, মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা নিয়ে সুনির্দিষ্ট ছকভিত্তিক গবেষণা চলমান রাখতে হবে।

পরবর্তী প্রজন্ম যেন মুক্তিযুদ্ধের অর্জনের ব্যাপকতা এবং এর ইতিহাস সম্পর্কে বিভ্রান্ত না হয় সেজন্য মুক্তিযুদ্ধের গবেষণায় বৃত্তি দেওয়া জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।

একাত্তরে ভারতীয় দৈনিক স্টেটসম্যানের সাংবাদিক হিরন্ময় কার্লেকার বিভিন্ন প্রতিবেদনে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেন। বাঙালির স্বাধীনতার জন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাকে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা দেয় বাংলাদেশ সরকার।

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য পাকিস্তান এখনও রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমা না চাওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেন হিরন্ময় কার্লেকার।

তিনি বলেন, পাকিস্তান ১৯৭১ সালে যে গণহত্যা চালিয়েছিল তার জন্য এখন পর্যন্ত ক্ষমা চায়নি। উল্টো দেশটি গণহত্যা নিয়ে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানি আর্মি ও তাদের দোসরদের যথপোযুক্ত শাস্তি হয়নি বলে তারা এখনও সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, তখন পাকিস্তান বারবার আপত্তি জানিয়ে ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে। ওদের উপযুক্ত শাস্তি হয়নি বলে এই সাহস দেখাচ্ছে।

যুদ্ধাপরাধে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের মৃত‌্যুদণ্ড কার্যকরের পর প্রতিবারই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে আসছে পাকিস্তান সরকার। দণ্ডিতদের ‘পাকিস্তানের বন্ধু’ বলে জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান।

তার পরিপ্রেক্ষিতে গণজাগরণ মঞ্চসহ আন্দোলনকারী বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের দাবি তোলা হয়। এই দাবিতে ঢাকায় পাকিস্তান হাই কমিশন ঘেরাও করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চের সহযোগী ছিলেন টমাস এ ডাইন। পাকিস্তানকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করা, শরণার্থীদের সাহায্য, বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষার জন্য বিশ্ব জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তিনি। এই অবদানকে সম্মান জানাতে তাকে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

ওই সময়ের স্মৃতিচারণ করে টমাস এ ডাইন বলেন, দিল্লিতে বসে যখন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি নিয়ে কাজ করছিলাম তখন শুরু হল মুক্তিযু্দ্ধ। ২৫ মার্চের কালো রাতের কথা আমি কখনও ভুলতে পারিনি। তখন খুব অবাক হয়ে দেখলাম, রাওয়ালপিণ্ডির সঙ্গে মার্কিন প্রশাসনের সম্পর্ক আরো গভীর হচ্ছে। বাংলাদেশের হতভাগ্য মানুষগুলোর কথা চিন্তা করে আমি আর চুপ করে বসে থাকতে পারলাম না। আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, সেও সমর্থন দিল। আমি বাংলাদেশের মানুষের জন্য কাজ করতে শুরু করলাম।

মিয়ানমারে নিধনযজ্ঞের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসা করেন টমাস এ ডাইন।

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের লাখো মানুষ ভারতে শরণার্থী হলেন। কী অবর্ণনীয় দুর্ভোগের মধ্যে তারা দিনাতিপাত করেছিলেন। ৪৬ বছর পরে সেই একই চিত্র দেখি, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। মিয়ানমার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা মানুষগুলোর জন্য বাঙালি তাদের সীমান্ত খুলে দিয়েছে। মানবিক বাংলাদেশ তাদের জন্য জমি দিল, খাদ্য দিল, আরো কত কী করছে। এই মানবিক বাংলাদেশ আমাকে বারবার মুগ্ধ করে।

মূল প্রবন্ধে শাহরিয়ার কবির বলেন, ধর্মকে পুঁজি করে তারা একাত্তরে ৩০ লাখ বাঙালিকে মেরেছিল, এখন তারা ধর্মের নামেই নিরীহ মানুষ হত্যা করছে। যতদিন একাত্তরের ঘাতক-দালালদের নির্মূল করা না যাবে, তারা এসব চালিয়ে যেতে থাকবে।

তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয় না বলেই আজকে একাত্তরের ঘাতক-দোসররা মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হল, তখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানাভাবে প্রভাব খাটিয়ে বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করতে চাইছে।

একাত্তরের ঘটনায় পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তা ও তাদের দোসরদের সর্বোচ্চ শাস্তি হলে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রাখাইন রাজ্যে গণহত্যা চালানোর সাহস পেত না বলে মন্তব্য করেন ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি।

একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি জানান তিনি।

যুদ্ধাপরাধীরা ’৭৫ পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তরুণদের মনোজগতে ‘যে আধিপত্য বিস্তার করেছে’ তাতে গণহত্যা বিষয়ক গবেষণা খুবই প্রয়োজনীয় বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি রাজনীতি করে। দেশের ৩০ শতাংশ মানুষ এখনও ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের চেতনাকে, তাদের বর্বরতাকে সমর্থন করে। বর্বরতার প্রতীক পাকিস্তানের প্রতিভূ ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের কেন আমরা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত করব? এসব আলোচনার জন্য গণহত্যা-নির্যাতন নিয়ে আমাদের আরও বেশি কথা বলতে হবে।

স্বাগত বক্তব্যে বীরপ্রতীক সাজ্জাদ আলী জহির বলেন, একাত্তরে পাকবাহিনীর দোসরদের বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন না হলে পরবর্তী সময়ে এর কঠিন মূল্য দিতে হবে।

সেমিনারের উদ্বোধনী পর্বের পরে প্রথম অধিবেশনে প্রধান বক্তা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। আলোচনায় অংশ নেন অধ্যাপক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, ভারতের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক জয়ন্ত কুমার রায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, ভারতের অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আর পি সিং ও টমাস এ ডাইন।

তোফায়েল আহমেদ বলেন, জাতির জনকের চিন্তা-চেতনায় ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন পাকিস্তান কাঠামোতে বাঙালির মুক্তি আসবে না। ভাষা আন্দোলন থেকে তিনি যে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে বিজয় দিয়ে সেই আন্দোলন শেষ করেছিলেন। ৭ মার্চের অলিখিত ভাষণে ধীর-স্থিরভাবে অকপটে নিরাশায় নিমজ্জিত জাতিকে মুক্তির চেতনায় উদ্দীপ্ত করেছিলেন।

পরে দ্বিতীয় অধিবেশনে প্রধান বক্তা ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম। আলোচনায় অংশ নেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, জুলিয়ান ফ্রান্সিস, ভারতের সাংবাদিক হিরন্ময় কার্লেকার, মানস ঘোষ ও কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়।

রবিবার দ্বিতীয় দিনের অধিবেশনে অংশ নিচ্ছেন মিশর, কম্বোডিয়া, ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও বাংলাদেশের ইতিহাসবিদ ও সমাজকর্মীরা।

Next Post

“মৃত্যুকে বিরহ ভেবে ভুল হয়” কাব্যগ্রন্থ থেকে

কে যাবে, কে যাবে না সেটি ভিন্ন প্রশ্ন তবু কেউ চলে গেলে কষ্ট হয়। কেউ চলে গেলে অত:পর আমরা বিদীর্ণ করি আমাদের দীর্ঘ সযত্ন রচনা, ভেঙে দিই ছায়ার সংযোগ, মুছে যাই প্রিয় সরগম, ছিঁড়ে ফেলি পুরনো পঞ্জিকা আবর্জনার ঝুড়িতে গুজে দিই স্মৃতিময় বিনুনির কাঁটা। এগুলো দোষের কিছু নয়, স্বস্তি প্রত্যাশায় প্রত্যেকের […]
Shahida Sultana

এগুলো পড়তে পারেন