সুফিজমের ওপর শাহরিয়ার কবিরের প্রামাণ্যচিত্র ‘মিথাত’স ড্রিম’

follow-upnews
1 0

৭ম শতাব্দীতে আরব উপদ্বীপে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের পর ভারতবর্ষ সহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রধানতঃ সুফীরা এই ধর্ম প্রচার করেছেন।


সাম্প্রতিককালের আল কায়দা-আইএস, ওয়াহাবী-সালাফী, হাসান আল বান্না, মওদুদী, সাঈদ কুত্ব্-এর উগ্র, অসহিষ্ণু জিহাদী ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত ভাষ্য হচ্ছে সুফীদের শান্তি, সম্প্রীতি ও সর্বজনীন মানবতার ইসলাম। এই সুফীদের ভেতর পশ্চিমা বিশ্বে সবচেয়ে পরিচিত নাম হযরত জালালউদ্দীন রুমী, যিনি বাস করতেন তুরস্কের আনাতোলিয়ার কোনিয়ায়। রুমীর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে প্রতি বছর কোনিয়ায় লক্ষ লক্ষ মানুষের আগমন ঘটে রুমীকে জানার জন্য। শুধু মুসলিম নয়, বহু অমুসলিমও আসে কোনিয়ায় যেখানে রয়েছে রুমীর মাজার, যেখানে রুমী লিখেছেন তার কালজয়ী রচনা— মসনবী, দিওয়ানে শামস-এ তাবরিযি ও দিওয়ানে কবীর সহ বহু কবিতা ও গান।
রুমীর অনুসারীদের দরবেশ বলা হয়, যারা কবিতা, সঙ্গীত ও নৃত্যকলাকে ইবাদতের অনুসঙ্গে পরিণত করেছেন। এদের প্রধান কেন্দ্র হচ্ছে কোনিয়া।
মধ্যযুগে রুমীর শিষ্য ও অনুসারী দরবেশরা সিরিয়া, মিশর, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান হয়ে ভারতবর্ষ পর্যন্ত এসেছিলেন ধর্ম প্রচারের জন্য। বাংলাদেশে যে সুফী সাধকরা ইসলাম প্রচার করেছেন তাদের ভেতর সর্বাগ্রগণ্য হচ্ছেন সিলেটের হযরত শাহজালাল, যিনি ছিলেন রুমীর ভাবশিষ্য, যার জন্মস্থান তুরস্কের কোনিয়া। পূর্ব ভারতের জনপদ সিলেটে তার আগমন ঘটেছিল ১৩০৩ খৃষ্টাব্দে।
সুফী সাধকদের এই দীর্ঘ ভ্রমণপথ ধরে আমরা কোনিয়া গিয়েছিলাম রুমীকে আরও জানার জন্য। কোনিয়ায় আমাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে তিন প্রজন্মের দরবেশ মিথাত ওযচাকলের (Mithat Ozchakal) সঙ্গে। মিথাত আমাদের রুমীর কথা বলেছেন।
মিথাতের পিতা এখন কোনিয়ার কালচারাল সেন্টারের পরিচালক এবং সেমা নৃত্যুদলের প্রধান। পুত্র মিথাতকে নিয়ে ফাহরি ওযচাকলের অনেক গর্ব। মিথাতের ছোট ভাইও দরবেশ হওয়ার সাধনা করছে।
দরবেশরা সমাজের ভেতর থেকে সামাজিক জীবন যাপন করে সমাজ ও মানুষের সেবা করেন, সর্বজনীন মানবতার দর্শন প্রচার করেন।
মিথাতের সঙ্গে শেষবার দেখা হয়েছে রুমির মৃত্যুবার্ষিকীতে ২০১৭-এর ডিসেম্বরে। মিথাত ও তার দল তখন দশদিন ব্যাপী আন্তর্জাতিক সুফী সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে সেমা পরিবেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেমা নৃত্যের পোষাক পরিধান থেকে শেষ পর্যন্ত সব কিছুতে ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসরণ করা হয়। গায়করা রুমির কালাম পরিবেশন করেন। আল্লাহ ও তার রসুলের প্রশস্তি গেয়ে হামদ ও নাত পরিবেশন করেন। শেষ করেন মোনাজাতের মাধ্যমে।
সেমা নৃত্য ছাড়াও মিথাতের আগ্রহ রয়েছে যন্ত্রসঙ্গীতে। বাঁশিকে তুর্কীরা বলে ‘নেই’ (Nei)। সুফী সঙ্গীতের জন্য নেই অপরিহার্য। মিথাত দু বছর ধরে ‘নেই’ বাজানো শিখছে রাফিকের কাছে।
রুমির শিক্ষা অনুযায়ী দরবেশরা মৃত্যুকে শোক মনে করেন না। রুমির মৃত্যুবার্ষিকীকে তারা বলেন বিবাহবার্ষিকী। যে প্রিয়তমকে পাওয়ার জন্য সুফীরা সারাজীবন সাধনা করেছেন, অপেক্ষা করেছেন, মৃত্যু সেই দীর্ঘ বিরহের অবসান ঘটায়। সুফীদের কাছে মৃত্যু বেদনার নয়, সবচেয়ে আপনজনের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আনন্দের। সেমা নৃত্য এক অর্থে স্রষ্টার সঙ্গে মিলিত হওয়ার আনন্দযাত্রা।
সেমা নৃত্যের আরও আবেদন আছে। সেমা পার্থিব জীবন থেকে অপার্থিব জীবনে, অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রারও অভিব্যক্তি।
যে বয়সে তরুণরা ভাগ্যান্বেষণে পশ্চিমে পাড়ি জমায় কিংবা কেউ কেউ ওহাবী-সালাফীবাদে আকৃষ্ট হয়ে জঙ্গী সন্ত্রাসী জিহাদী কার্যক্রমে যুক্ত হয় মিথাত কেন ভিন্ন পথ গ্রহণ করলেন?
ইস্তাম্বুলের তরুণী চিত্রকর আসমা ভালবেসে বিয়ে করেছেন মিথাতকে। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে আসমা বললেন— 
রুমীর মানবিক দর্শন, শান্তি ও ভালবাসার ইসলাম প্রচারের জন্য মিথাত ও তার পিতা ফাহরি ওযচাকল-এর দরবেশদের দল বহু দেশ সফর করেছেন।
তুরস্কে রুমীর সমসাময়িক আরেক সুফী সাধক, যিনি আনাতোলিয়ার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত চারণের বেশে মানবতার শাশ্বত বাণী প্রচার করেছেন— তার নাম ইউনুস এম্রে। রুমীর আধ্যাত্মিক গুরু সুফীসাধক শামস তাবরিজীও শেষজীবন কাটিয়েছেন কোনিয়ায়। তাদের সমসাময়িক আন্দালুশিয়ার সুফী সাধক ইবনে আরাবিও আনাতোলিয়া এসেছিলেন।
রুমীর পাশাপাশি অন্য সুফীদেরও সমানভাবে মান্য করেন মিথাত।
ওহাবী-সালাফীরা সুফীদের শান্তি ও সম্প্রীতির ইসলাম পছন্দ করেন না। কট্টর জিহাদীপন্থীরা যখনই সুযোগ পেয়েছে তখনই সুফীদের উপর হামলা করেছে, তাদের আবাস ও মাজার ধ্বংস করেছে। ওহাবী-সালাফী এবং তাদের পূর্ব ও উত্তরসূরীরা সঙ্গীত, নৃত্য ও চারুকলা সহ যা কিছু মানুষের সুকুমার প্রবৃত্তির বিকাশ ঘটায় সব হারাম ঘোষণা করেছে। তাদের রাজনৈতিক ইসলাম ও ধ্বংসাত্মক জিহাদের কারণে মানব সভ্যতার বহু স্মারক ধ্বংস হয়েছে।
পাকিস্তানে রাজনৈতিক ইসলামের ধ্বজাধারী সামরিক বাহিনী এবং তাদের রাজনৈতিক দোসর ওহাবীবাদী জামায়াতে ইসলামী ১৯৭১ সালে ইসলামের দোহাই দিয়ে ৩০ লক্ষ নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। তাদের এই গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ থেকে মসজিদে ইবাদতরত মুসলমানরাও রেহাই পায়নি।
ধর্মের নামে হত্যা, সন্ত্রাস ও ধ্বংসযজ্ঞের অবসান ঘটানোর জন্য স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। বাংলাদেশের মূল সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। স্বাধীন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারো নাই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাধা দেয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খৃষ্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হল এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না।’
স্বাধীনতাবিরোধীরা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো মৌলবাদী, সন্ত্রাসী ব্যর্থ রাষ্ট্র বানাবার জন্য নৃশংসভাবে হত্যা করছিল বঙ্গবন্ধু এবং তার প্রধান সহযোগীদের যাদের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়েছে, যারা প্রণয়ন করেছিলেন ১৯৭২-এর অনন্যসাধারণ সংবিধান। ’৭১-এর গণহত্যাকারীদের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলো বঙ্গবন্ধুর সরকার সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকান্ডের পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে ইসলামের নামে গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সহযোগীদের আবার পাকিস্তানের মতো ধর্মের নামে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়ে বাংলাদেশে ধর্মের নামে সন্ত্রাসের বিষবৃক্ষ বপণ করেছেন, যার বিষাক্ত ফল এখনও আমরা ভোগ করছি।
ধর্মের নামে রাজনীতি করার ভয়ঙ্কর পরিণাম হচ্ছে পাকিস্তান। জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা আবুল আলা মওদুদীর রাজনৈতিক জিহাদী ইসলাম পাকিস্তানকে আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে। ধর্মের নামে রাজনীতি করতে গিয়ে পাকিস্তান যে তালেবান ও আল কায়দাদের মদদ দিয়েছে তারা আজ পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চাইছে। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তারা পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের সাহিওয়ালে সুফী সাধক শাহবায কলন্দরের মাজারে আত্মঘাতী বোমা হামলা করে প্রায় দু’শ ধর্মপ্রাণ নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে, যাদের অধিকাংশ ছিল নারী ও শিশু।
২০০৪ সালে জামায়াত-বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের পোষা জঙ্গীরা সিলেটে হযরত শাহজালালের মাজারে ভয়াবহ বোমা হামলা চালিয়েছিল, যে সুফীসাধক বাংলাদেশে এসেছিলেন শান্তির ও সহমর্মিতার ইসলাম প্রচার করার জন্য। এই হামলা চালিয়ে জঙ্গীরা জেয়ারতে আসা বৃটিশ রাষ্ট্রদূত আনোয়ার চৌধুরীকে হত্যা করতে চেয়েছিল। হামলায় দুজন ভক্ত নিহত হয়েছিলেন এবং বৃটিশ রাষ্ট্রদূত গুরুতর আহত হয়েছিলেন। ২০১৬ সালের জুলাইয়ে তাদের অনুসারীরাই বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার গুলশানের একটি কাফেতে আত্মঘাতী হত্যা চালিয়ে ২৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে, যাদের অধিকাংশ ছিলেন বিদেশী।
বাংলাদেশে জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসের ধর্মপিতা হচ্ছে ওহাবি-সালাফিবাদের অনুসারী জামায়াতে ইসলামী— যারা ভিন্নমত, ভিন্নধর্ম, ভিন্ন জীবনধারায় বিশ্বাসীদের ইসলামের নামে হত্যা করা ইমানি কর্তব্য মনে করে।
২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে জোট বেঁধে ক্ষমতার শরিক ছিল জামায়াতে ইসলামী। বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বদান্যতায় জামায়াতের দুই শীর্ষ নেতা, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালের দুই প্রধান গণহত্যাকারী মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। যে বাংলাদেশকে তারা জন্মকালে আঁতুড়ঘরে হত্যা করতে চেয়েছিল, যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করতে গিয়ে তারা ৩০ লক্ষ স্বাধীনতাকামী বাঙালিকে হত্যা করেছিল, ক্ষমতায় এসে তারা বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ সন্ত্রাসী মৌলবাদী রাষ্ট্র বানাবার উদ্যোগ নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুসারী ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের পাশাপাশি মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতি কর্মী এবং সংখ্যালঘু ধর্মীয়সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করে বাংলাদেশকে জেনারেল জিয়াউল হকের পাকিস্তান ও মোল্লা উমরের আফগানিস্তানের জঙ্গী ইসলামী রাষ্ট্র বানাবার উদ্যোগ নিয়েছিল। তখন বাংলাদেশের তিন লক্ষাধিক হিন্দু নাগরিক ১৯৭১-এর মতো সর্বস্ব হারিয়ে প্রতিবেশী ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।
২০০৮-এর নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মহাজোট সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ৩০ লক্ষ শহীদ পরিবার যুগের পর যুগ রাজপথে আন্দোলন করেছে, সেই গণহত্যাকারীদের বিচারের উদ্যোগও ৪০ বছর প্রতীক্ষার পর শেখ হাসিনার সরকার আরম্ভ করেছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে এ দেশের জনগণ জামায়াত-বিএনপির নেতৃত্বাধীন মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক-যুদ্ধাপরাধী অধ্যুষিত জোটকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল। কারণ, ক্ষমতায় থাকাকালে বাংলাদেশকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছিল। এই পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য জামায়াত-বিএনপি জোট আরও সাধারণ মানুষকে হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। কখনও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়ে, কখনও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ভন্ডুল করার জন্য, কখনও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নামে তারা নিরীহ মানুষকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হাজার হাজার বাড়িঘর, ধর্মীয় ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেছে, ভিন্ন ধর্মের পুরোহিত, যাজক, ভিক্ষুদের হত্যা করেছে। ভিন্নমতের লেখক প্রকাশক এমনকি বিদেশী নাগরিকদের হত্যা করে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের ধারা অবরুদ্ধ করার পাশাপাশি বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করেছে। ২০০১-এর মতো জামায়াত-বিএনপির জোট যদি কখনও ক্ষমতায় আসে বাংলাদেশ উন্নয়নের আলোকিত মহাসড়ক থেকে ছিটকে পড়বে মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের অন্ধকার চোরাগলিতে।
বাংলাদেশের মানুষ সন্ত্রাস নয়, শান্তি চায়, ৩০ লক্ষ শহীদের স্বপ্নের বাংলাদেশ দেখতে চায়, যেখানে ধর্মের নামে হানাহানি থাকবে না, যেখানে ধর্ম-বর্ণ জাতিসত্তা নির্বিশেষে সকল মানুষ সমান অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বাস করবে, যে দেশ বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হবে।
রুমির মৃত্যুবার্ষিকীতে তুরস্কের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ ভক্ত ও অনুরাগীর আগমন ঘটে কোনিয়ায়। তিন মাস আগে থেকে সব হোটেল অগ্রিম বুক করা হয়। আমরা জায়গা পেয়েছিলাম রুমির মাজারের কাছে দরবেশদের এক অতিথিশালায়। সেখানে দেখা হয়েছে এক ফরাসী গবেষক ও লেখকের সঙ্গে। সুফীবাদ সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে নিজেই সুফী হয়ে গেছেন। প্যারিসের বিখ্যাত সর্বোণ (Sorbonne) বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার নিশ্চিত জীবন ছেড়ে দিয়ে তিরিশ বছর তুরস্কের কাপাদোকিয়ায় পড়ে আছেন। সুফীবাদ সম্পর্কে জানার জন্য তিনি পাকিস্তানেও গিয়েছিলেন।
তুরস্কের তরুণ দরবেশ মিথাত ওযজাকল মনে করেন রুমী ও সুফীদের মানবিক ইসলামই পারে ইসলামের নামে হত্যা ও সন্ত্রাসের অবসান ঘটাতে।
মিথাত তাদের সেমা সাধনা ব্যাখ্যা করেছেন। মানুষের ভেতর অবস্থান করা পাশব প্রবৃত্তিকে ধ্বংস না করে, মানুষের হৃদয় ভালবাসার প্রদীপ প্রজ্জ্বলন না করে বিশ্ব থেকে অসাম্য, অশান্তি, সংঘাত, সন্ত্রাস দূর করা যাবে না।
২০০১ সালে ৯/১১-এ জিহাদের নামে আল কায়দার জঙ্গীরা যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার ধ্বংস করেছিল ইসলামের দোহাই দিয়ে। এরপর রুমীর রচনাবলী যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রির শীর্ষে স্থান লাভ করেছে। সময় যত অতিবাহিত হচ্ছে অশান্ত সংঘাতময় বিশ্বে রুমীর সর্বজনীন মানবতার দর্শন আরও প্রাসঙ্গিক হচ্ছে। বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মুসলমানরা জামায়াত-বিএনপির সন্ত্রাসী রাজনৈতিক ইসলাম পরিত্যাগ করে ২০০৮ সালে বিপুল ভোটে জয়ী করেছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বপক্ষের মহাজোট। আগামীতেও তারা তাই করবে। সংঘাতময় মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশ একদিন শান্তি ও সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
মুসলিম বিশ্বের তরুণদের একটি অংশের চেতনায় ওহাবি, সালাফী মৌলবাদ আধিপত্য বিস্তার করেছে। আমরা আশা করি একদিন এই বিভ্রান্ত তরুণরা ইসলামের সন্ত্রাস ও উন্মাদনার আচ্ছন্নতা থেকে মুক্ত হবে। মিথাতের মতো ধর্মের ভেতর শান্তি, সম্প্রীতি ও সর্বজনীন মানবপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে।


শাহরিয়ার কবির

লেখক, সাংবাদিক ও প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা

Next Post

নির্মূল কমিটির আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা // মুনতাসীর মামুন

১ শাহবাগের আন্দোলন নিয়ে তরুণ লেখক, মধ্যবয়সী অ্যাকাডেমিশিয়ান ও আরো অনেকের মধ্যে দারুণ আগ্রহ দেখেছি। তারা এ বিষয়ে প্রবন্ধ/বই লিখেছেন। এখনও গণজাগরণের উদাহরণ হিসেবে ঢাকার শাহবাগের গণজাগরণের কথা আলোচিত হয়। তখন আমার হঠাৎ মনে হয়েছে, সব আন্দোলন নিয়ে এতো আলোচনা হয় নির্মূল কমিটি [একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সংক্ষেপে নির্মূল […]
গণহত্যা নির্যাতন ও আর্কাইভ জাদুঘর