নিজেকে হারাই: কানামো কাহিনী (প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব)

follow-upnews
0 0

সুদূরের পিয়াসী

পাহাড়ে ওঠা আমার কাছে নিজেকে ছাড়িয়ে যাবার মত। নিজের সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করা। নিজের কাছে হেরে যাওয়া আবার নিজের কাছেই জয়ী হওয়া। পাহাড়ে গেলে আমি নিজেকে খুঁজে পাই। টের পাই নিজের ভিতরের একাগ্রতা এবং মানসিক শক্তি। পাহাড়ে গেলে মনে হয় আমি নিজেকে ছাড়িয়ে আরও বহুদূর অতিক্রম করতে পারি। তাইতো বার বার মন ছুটে যায় পাহাড়ে।

ঠিক কখন কীভাবে কানামো যাবার পরিকল্পনা করেছিলাম আমার মনে নেই। ইচ্ছা হচ্ছিল উঁচু পাহাড়ে ওঠার একটা অভিজ্ঞতা নিতে। এর আগে জাপানের মাউন্ট ফুজি সামিট ছিল আমার সবচেয়ে উঁচুতে ওঠার অভিজ্ঞতা। সেটাকে ছাড়িয়ে আরো উঁচু কোনো পাহাড়ে ওঠার ইচ্ছাতেই পরিকল্পনা অনুযায়ী মাউন্ট কানামোর আগমন। মাউন্ট কানামোকে বেছে নেওয়ার পিছনে যে কারণ গুলো কাজ করেছে তার মধ্যে অন্যতম হল, পবর্তটির অবস্থান, উচ্চতা, ডিফিকালটি লেভেল, সময় এবং অর্থ। ভারতের হিমাচল প্রদেশের হিমালয়ের জান্সকার পর্বতশ্রেণিতে অবস্থিত মাউন্ট কানামোর উচ্চতা ৫৯৭৪ মিটার। চূড়াটি ভারত ও তিব্বতের মধ্যবর্তী প্রাচীন জনপদ স্পিতি অঞ্চলে। ডিফিকালটি লেভেল মধ্যম থেকে কঠিন। বাংলাদেশ থেকে গিয়ে এই পাহাড় সামিট করার জন্য দুই সপ্তাহ সময়ই যথেষ্ট। আর নেপালে যাবার প্লেন ভাড়া দিয়েই কানামো অভিযান সম্পন্ন করা সম্ভব। এ কারণেই নেপালের সব আকর্ষণীয় পর্বত ছেড়ে মাউন্ট কানামো যাওয়ার জন্য মনস্থির করলাম।

জুলাই, ২০১৬ তে বিনোদন ছুটি পেলাম ১৫ দিন। ভাবলাম, এই সুযোগে কানামো অভিযান শেষ করি। ঢাকা-দিল্লী প্লেনের রিটার্ন টিকেট করে ফেললাম। সেই সাথে চলল অন্যান্য প্রস্তুতি। কিন্তু আবহাওয়ার রিপোর্ট দেখে তো মাথা খারাপ! যে সময় টা কানামো সামিটের জন্য ঠিক করেছি ঠিক সেই সময় প্রায় এক সপ্তাহ জুড়ে স্পিতি অঞ্চলে বৃষ্টির ঘনঘটা। একা একা যাবার পরিকল্পনা ছিল। আবহাওয়ার এমন রিপোর্ট দেখে আর মন সায় দিল না। তাই সেই ১৫ দিনের ছুটি রাজস্থানেই কাটিয়ে দিলাম।

অগাস্ট, ২০১৬ এর এক সকালে একাডেমিক ক্যালেন্ডারে চোখ বুলাতে গিয়ে দেখি ঈদ-উল-আযহার সময় দুই সপ্তাহের ছুটি আছে। সাথে সাথে স্পিতি অঞ্চলের এক্সটেন্ডেড ওয়েদার ফোরকাস্ট চেক করে দেখলাম ঐ ছুটির সময় ভালো থাকবে আবহাওয়া। দ্বিতীয় আর কোনো চিন্তা মাথায় না এনে আবারো স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম মাউন্ট কানামোর। আবারো শুরু হল প্রস্তুতি।

কত কিছু যে লাগে প্রায় ছয় হাজার মিটার উচ্চতার একটা পাহাড়ে উঠতে! এর মধ্যেই আমাদের এডভেঞ্চার গ্রুপ ‘দ্যা কোয়েস্ট’ এর দুই সদস্য শান্তনু আর সজীবের সাথে যোগাযোগ হল, যারা কানামো সামিট করতে আগ্রহী। এর আগে ওদের সাথে একটাই মাত্র ট্রিপে গিয়েছিলাম, ‘পাইন্দু খাল এক্সপেডিশন’ এ। সেই ট্রিপে খুব যে একটা বোঝাপড়া হয়েছিল পরস্পরের সাথে সেটা বলব না তবুও আমি ভাবছিলাম এক সাথে কানামোর উদ্দেশ্যে যাওয়া যেতেই পারে। যদি দেখি মতের মিল হচ্ছে না, তাহলে আমি আমার মত আগাবো। এরকমভাবেই ওদের সাথে কথা বলে নিলাম।

প্রস্তুতি নেওয়া চলল পুরোদমে। প্রাথমিকভাবে ঠিক হল নিজেদের জিনিসপত্র নিজেরাই সব বহন করব। শুকনো খাবার হিসেবে নিলাম কিছু স্নিকার আর কিটক্যাট বার, শুকনো ফল, খেজুর, ওটমিল, নুডলস আর সুপের প্যাকেট। তাপমাত্রা রাতের বেলা, বা অতি উচ্চতায় হিমাঙ্কের নিচে নেমে যেতে পারে, সেই হিসেবে চলল গরম কাপড় সংগ্রহ। মাইনাস তাপমাত্রায় পরার জন্য কিছু ইনার আমি মস্কো থেকে কিনেছিলাম। সেই গুলো ব্যাগে ঢুকালাম। বাংলাদেশে অত ঠাণ্ডা পড়ে না তাই গরম কাপড়ের স্টক তেমন ছিল না। দীর্ঘদিন বরফের দেশে থেকে যখন একেবারে নিজের দেশে ফিরে আসি গরম কাপড় সব বস্তায় করে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিলাম। অবহেলার প্রতিদান হিসাবেই হয়ত কানামো যাবার প্রস্তুতিকালে বুঝলাম গরম কাপড় যা আছে তা দিয়ে কানামো যাওয়া যাবে না।

অগাস্ট মাসের এই গরমে এখন শীতের কাপড় কই পাই? আজিজ মার্কেটের পিক-৬৯ ’র রাকাকে বললাম সমস্যার কথা। রাকা বলল দোকানে যেতে, ওদের কাছে কিছু আছে শীতের কাপড়। রাকা আর রাব্বির পরামর্শে পিক-৬৯ ’র সংগ্রহ থেকে নিলাম নর্থ ফেসের একটা আউটার শেল আর লোলা ওমেনের একটা ডাউন জ্যাকেট। হাই অল্টিচুডের কম তাপমাত্রায় নর্থ ফেসের কাপড় যে সাপোর্ট দেয় তা পরীক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও আমি লোলার ডাউনটাই নিলাম, কারণ, ওটা আমার খুব ভালো ফিট করেছিল, আর নর্থ ফেসের ডাউন থেকেও ভালো মনে হয়েছিল। যাইহোক লোলা আমাকে নিরাশ করেনি, সে গল্প পরে বলব। পিক-৬৯ থেকে আরো নিলাম একটা ড্রাই ব্যাগ, হ্যামক আর পিক-৬৯ ’র লোগো প্রিন্ট করা রেইন কভার যা পুরো ভ্রমণে আমার ডয়টারের ব্যাগ দুটোকে রক্ষা করেছে। নিজামুদ্দিন ভাইয়ের কাছ থেকে পেলাম একটা স্লিপিং ব্যাগ, গ্লভস, হট ওয়াটার ব্যাগ আর একটা ইন্ডিয়ান সিম। নিজাম ভাই পরামর্শ দিলেন ছোট্ট একটা ফ্লাস্কও সাথে নিতে।

সকল প্রস্তুতি শেষে কলকাতা হয়ে দিল্লী পৌঁছলাম ৮ সেপ্টেম্বর সকালে। হোটেলে চেক-ইন করেই ছুটলাম নইদার ডিক্যাথলনে। সেখান থেকে কিনলাম ফ্লিস জ্যাকেট, ছোট্ট একটা ফ্লাস্ক আর হাত মোজা। চশমা ছাড়া চোখে দেখি না কিছুই তাই চশমার উপর দিয়েই পরার মত একটা OTG পোলারয়েড গ্লাস কিনলাম। নইদার ডিক্যাথলনে সেটা ছিল না, ওরা ওদের অন্য একটা শাখা থেকে আমাকে এনে দিয়েছিল গ্লাসটা। ওদের এই সাহায্যটা অনেক মুগ্ধ করেছিল আমাকে।

৯ সেপ্টেম্বর বিকালে দিল্লী থেকে মানালির বাস ছাড়বে। সকালটা ফ্রি ছিলাম তাই ভাবলাম একটু দিল্লী দর্শন করি। ভুলটা করলাম সেখানেই। কড়া রোদ মাথায় নিয়ে গেলাম চাঁদনীচক। ঘুরলাম লাল কেল্লা আর দিল্লী জামে মসজিদ। করিমের বিখ্যাত(?) বিরিয়ানি খেয়ে হোটেল থেকে ব্যাগগুলো নিয়ে মানালির বাসে উঠে বসলাম। এসি বাসে আরাম করেই বসলাম। ঘুম পাচ্ছিল অনেক, ঘুমাচ্ছিলাম কিন্তু আরাম পাচ্ছিলাম না। শব্দে আমার ঘুমের খুব সমস্যা হয় আর ওই বাসে সারাটা রাত পাঞ্জাবী ভাঙরা গান বাজিয়েছে। সকালে যখন মানালি পৌঁছাই আমি তখন চোখ মেলতে পারছি না, দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। অটোওয়ালাকে একটা বাজেট দিয়ে বললাম তার পছন্দমত কোন হোটেলে পৌঁছে দিতে। হোটেলে পৌঁছেই সেই যে বিছানায় শুয়েছি উঠেছি চব্বিশ ঘণ্টা পরে।

এই চব্বিশ ঘন্টা আমার কোনো হুশ ছিল না। এর মধ্যে আমি এক ফোঁটা পানিও খাই নাই। শান্তনু এক বাটি ওটমিল রেডি করে দিয়েছিল, সেটা কিভাবে গিলেছি মনে করতে পারি না। চব্বিশ ঘণ্টা পরে একটু যখন উঠে বসতে পারলাম, বুঝলাম গায়ে জ্বর, মুখ পুরা তিতা, কিচ্ছু খাওয়ার রুচি নাই। এর মধ্যেই আবার হোটেল বদলে সজীবরা যে হোটেলে উঠেছে সেখানে উঠলাম। সেখানে গিয়েও আবার চার-পাঁচ ঘণ্টা ঘুম। এর মাঝে সকালের নাস্তা খাবার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু খেতে পারিনি, খাবার নষ্ট করে চলে এসেছি। পরের দিন, অর্থাৎ ১১ সেপ্টেম্বর আমাদের কিবের গ্রাম, যেখান থেকে কানামোর জন্য ট্রেক শুরু করতে হবে, সেখানে রওনা হওয়ার কথা। ১০ তারিখ বিকালের দিকেই আমি বুঝতে পারলাম এইরকম দুর্বল শরীর নিয়ে আমার মানালি ছেড়ে যাওয়া উচিত হবে না। কারণ, আমাকে ধীরে ধীরে উঁচুতে উঠতে হবে। সুস্থ মানুষেরাই অতি উচ্চতায়, স্বল্প অক্সিজেনে এএমএস (Acute Mountain Sickness) হয়। আর আমি যদি এই রকম অসুস্থ অবস্থায় অগ্রসর হই দেখা যাবে কাজা থেকেই আমাকে আবার মানালি ফিরে আসতে হচ্ছে। এক দিকে শারীরিক অসুস্থতা আরেকদিকে ভীষণ একটা মানসিক সংকটে পড়ে গেলাম। কত কিছু পেছনে ফেলে মানালি পর্যন্ত এসেছি, আর কি আমি আগাতে পারব না?

পরিবার পরিজনের সাথে ঈদ করা বাদ দিয়ে যে উদ্দেশ্যে এসেছি, আমি কি এভাবে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাব? আমার এই ছুটিটা এইভাবে নষ্ট হলে পরবর্তী ছুটি আমি পাব রোজার ঈদে, সে অনেক দেরি, সে সময় কি স্পিতির আবহাওয়া ভালো থাকবে? আমার যাইহোক, আমার সাথে যে কোয়েস্ট এর সঙ্গীরা আছে তারা যেন ঠিক মত যায় তাহলে, এইরকম অসংখ্য ভাবনা আর সঙ্গীদের প্রতিনিয়ত তাড়া “আপু মানালি থেকে আপনার প্রয়োজনীয় সব কিছু নিয়েছেন তো”। এর মাঝেই কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিলাম, না এই অসুস্থ শরীর নিয়ে আমি কাল কিছুতেই মানালি ছেড়ে যাচ্ছি না। (চলবে)

সুদূরের পিয়াসী

Next Post

সৈয়দ শামসুল হক আর নেই

সৈয়দ শামসুল হকের লেখা বিখ্যাত একটি গান। মৃত্যুর অনিবার্যতা নিয়ে তিনি গানটি লিখেছিলেন- হায়রে মানুষ, রঙ্গীন ফানুস দম ফুরাইলেই ঠুস তবুতো ভাই কারোরই নাই একটুখানি হুশ হায়রে মানুষ, রঙ্গীন ফানুস রঙ্গীন ফানুস, হায়রে মানুষ।। পূর্ণিমাতে ভাইসা গেছে নীল দরিয়া সোনার পিনিশ বানাইছিলা যতন করিয়া চেলচেলাইয়া চলে পিনিশ, ডুইবা গেলেই ভুস।। […]