বুয়েটের প্রথম তিনজন ছাত্রী। বুয়েটের প্রথম মেয়ে শিক্ষার্থী তারা। তারা প্রথমে কোর্টে মামলা করেন যে, কেন তারা বুয়েটে পড়তে পারবেন না। তখন মেয়েদের বুয়েটে পড়া নিষিদ্ধ ছিল। মামলায় জয়ী হবার পর বুয়েটে প্রথম মেয়ে শিক্ষার্থী হিসেবে পড়ার সুযোগ পান। ১৯৬৪ সালের কথা।
বাবা কবির উদ্দিন ছিলেন তৎকালীন ইপুয়েট তথা পূর্ব-পাকিস্তান প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বর্তমান বুয়েট) পুরাপ্রকৌশল বিভাগের শিক্ষক। সেই সূত্রে বেড়ে ওঠা তৎকালীন ইপুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। ছুটে বেড়িয়েছেন ইপুয়েটসহ ঢাকা মেডিকেল কলেজের আঙিনায়। প্রাণভরে দেখেছেন ক্যাম্পাসে তৎকালীন শিক্ষার্থীদের আনাগোনা। কিন্তু প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের কাঁধে ঝোলানো টি-স্কেল এবং হাতে বয়ে নেওয়া ড্রইং বোর্ড ও ড্রইং পেপারের দৃশ্যই যে একদিন তার জীবনের চলার পথটাকে ঠিক করে দেবে, এনে দেবে দেশের প্রথম নারী প্রকৌশলী হওয়ার সম্মান, সেটা হয়ত তিনি ভাবতেও পারেননি। বলছিলাম, বাংলাদেশের প্রথম তিন নারী প্রকৌশলীদের একজন খালেদা শাহরিয়ার কবিরের গল্প। যিনি ডোরা রহমান নামেই পরিচিত।
কথা হয় দেশের প্রথম নারী প্রকৌশলী ডোরা রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ১৯৬৪ সাল, আমি তখন ইডেন থেকে এইচএসসি পাস করি। আমার বান্ধবী শিরিণ সুলতানার সাথে পরামর্শ করি ইপুয়েটে প্রকৌশল নিয়ে পড়ার বিষয়ে। কিন্তু চিন্তা হচ্ছিল কীভাবে ভর্তি হব ইপুয়েটে। কারণ, তখন পর্যন্ত কোনো মেয়ে শিক্ষার্থী ভর্তিই হয়নি প্রকৌশল বিভাগে। বলা চলে, প্রকৌশলে মেয়েদের ভর্তি হওয়াটা এক প্রকার নিষিদ্ধই ছিল। আমাদের আগের বছর একটা মেয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি হতে গেলে তাকে একা মেয়েসহ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে ভর্তি করা হয় না। তাই আমরা ভাবলাম, আমরা যদি একা না গিয়ে কয়েকজন গিয়ে ভর্তি হতে চাই তাহলে হয়তবা কাজে দেবে। কোনোভাবে আমাদের এই পরিকল্পনার কথা পৌঁছে গেল হলিক্রসের মেয়ে মনোয়ারা বেগমের কাছে। তিনিও এসে যোগ দিলেন আমাদের সাথে। শেষপর্যন্ত আমরা ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে টিকে যাই তিনজনই।
কিন্তু শিক্ষক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ প্রথমে আমাদের কোনোভাবে ভর্তি করতে না চাইলেও আমাদের জোরাজুরিতে একটা কন্ডিশনে ভর্তি করতে রাজি হন। সেটা হলো, আমরা কোনোভাবেই পুরকৌশল বিষয় নিতে পারব না। আমরা নিজেদের মনের বিরুদ্ধে গিয়েও তাদের কন্ডিশন মেনে নিয়েছিলাম আপাতত। আপাতত বলছি, কারণ, ইপুয়েটে তখন প্রথম একবছর সবাইকে একসাথে ক্লাস করতে হতো। বিভাগ নির্বাচন করতে হতো দ্বিতীয় বর্ষে এসে। তাই ভাবলাম, আগে ভর্তি হয়ে নিই, তারপর দ্বিতীয় বর্ষে দেখা যাবে কোন বিভাগ নির্বাচন করি। এক বছর পার হয়ে গেল। বিভাগ বাছাইয়ের সময় এসে গেল। পূর্ব কন্ডিশন মেনে মনোয়ারা নিয়ে নিল কেমিকৌশল বিভাগ। কিন্তু আমি আর শিরিন সুলতানা চেয়ে বসলাম পুরকৌশল বিভাগ। এবার তো যেন পুরো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাথায় বাজ পরে গেল।
তারা বলল, এ কাজ কোন ভাবেই সম্ভব না। কারণ, পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থীদের সার্ভের জন্য শহরের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়, এমনকি সাভারে গিয়েও বিভাগীয় কাজে একমাস সার্ভেসহ বিভিন্ন গবেষণামূলক কাজ করতে হয়। আমরাও ছাড়ার পাত্রী নই। আমরা বললাম, সংবিধানের কোথাও কি বলা আছে যে, মেয়েদের পুরকৌশলে পড়া যাবে না? যদি না থাকে, তাহলে আমরা আইনের আশ্রয় নিতে বাধ্য হব। তখন আর কিছু না বলে ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ আমাদের ভর্তি করে নেয়। এতেই যেন পুরো শহর তথা দেশে শোরগোল পড়ে যায়। মেয়েরাও প্রকৌশলে পড়ালেখা করছে! অনেক দূর-দূরান্ত থেকেও লোকজন আসা শুরু করে আমাদের এক নজর দেখতে।
আমি এবং শিরিণ সুলতানা ১৯৬৮ তেই পাস করে বের হই, কিন্তু মনোয়ারা দুই বছর রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় সে বের হয় ’৭০-এ । এখানে একটা কথা বলতেই হয়— প্রকৌশলে আমরা প্রথম নারী শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের ক্লাসমেট এবং শিক্ষকদের কাছ থেকে যথেষ্ট আন্তরিকতা পেয়েছি। চাকরি জীবনেও অনেক সম্মান পেয়েছি প্রথম মেয়ে প্রকৌশলী হিসেবে। তবে এখন পর্যন্ত যেই বিষয়টা সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে, অর্থাৎ যেই বিষয়টার জন্য গর্ববোধ হয়, সেটা হচ্ছে— আমাদের সেদিনের সেই দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত আমাদের পরবর্তী মেয়েদের প্রকৌশল বিষয়ে পড়ার পথকে সুগম এবং মসৃণ করেছিল।
২০০৪ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক পদ থেকে অবসর নিয়ে ডোরা রহমান বসবাস করছেন রাজধানী ঢাকাতে এবং শিরিণ সুলতানা প্রবাসজীবন কাটাচ্ছেন সুদূর যুক্তরাষ্ট্রে। মনোয়ারা বেগম মারা যান ২০০২ সালে।
দোরা রহমানের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মামুনুর রশিদ রাজিব